প্রচ্ছদ নিবন্ধ - হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



প্রচ্ছদ নিবন্ধ


বাইশে শ্রাবণ­­­
হিমাদ্রি মুখোপাধ্যায়



দিনানুদিনের আলপথ দিয়ে হেঁটে চলি আমরা। সে পথ কখনও সরল, কখনও বক্র---পথের শেষ কোথায়, তা কেউ জানি না, জানার প্রয়োজনও হয়তো নেই। তবে অবিশ্রাম এই পথ চলার মাঝে কোনও কোনও দিন আসে আমাদের, যাকে বলা যায় "তুমি কিছু দিয়ে যাও মোর প্রাণে/গোপনে", অথবা যার দিকে আর্ত দুচোখ মেলে আমরা বলে থাকি---"বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে"...এরকম-ই এক দিনের নাম হয়তো বাইশে শ্রাবণ। পথিক আমরা, এমনি এক বরিষণ মুখরিত শ্রাবণ দিনে আমাদের পান্থজনের সখা চলে গিয়েছিলেন।

১৯৬১ সাল। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ। সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করলেন কালোত্তীর্ণ এক তথ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথ। ছবির শুরুতেই ফ্রেমে ধরা পড়লো, কলকাতার রাজপথে লক্ষ মানুষ চলেছে এক দীর্ঘ শবযাত্রায়। অন্তরাল থেকে গমগম করে উঠলো সত্যজিতের ধীরোদাত্ত কণ্ঠস্বর--"অন দ্য সেভেন্থ অফ অগাস্ট, নাইনটিন হান্ড্রেড এন্ড ফর্টিওয়ান, ইন দ্য সিটি অব ক্যালকাটা, এ ম্যান ডায়েড"---উনিশশো একচল্লিশ সালের সাতই আগস্ট, কলকাতা শহরে একটি মানুষ মারা যান। একটি মানুষ মাত্র, একবারও তিনি উচ্চারণ করেন না তার নাম, কেননা তিনি জানেন মানুষের মৃত্যু হয়, রবিঠাকুরের মৃত্যু হয় না কোনওদিন। শবযাত্রার অন্তরাল থেকে তখনও অবিশ্রাম তিনি বলে চলেছেন ইংরেজিতে---তাঁর নশ্বর শরীর ভষ্মীভূত হবে সত্য, কিন্তু যে উত্তরাধিকার তিনি রেখে গেলেন তাঁর গদ্যে, কবিতায়, নাটকে, গানে, ছবিতে-- কোনও অগ্নি কোনওদিন তাকে দগ্ধ করতে সমর্থ হবে না।

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ, দুপুর বারোটা দশ। দাবানলের মতো খবর ছড়িয়ে পড়লো দেশের প্রতিটি প্রান্তে--রবি অস্তমিত। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব কোনও সংবাদ যেন। বিরামবিহীন বৃষ্টি, তার-ই মধ্যে উদভ্রান্ত কলকাতা শহর সেদিন নেমে এলো রাস্তায়। পাগলের মতো নজরুল ছুটছেন বেতার কেন্দ্রে, বিশাল মই আর ফটো তোলার সরঞ্জাম নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চলেছেন নিমতলার দিকে। লোকারণ্য রাজপথ, তিনি এগুতে পারছেন না, তবু পৌঁছতে তো তাঁকে হবেই--তিনি ছাড়া কে দিতে পারে মহত্তম এই সৎকারের ধারাবিবরণী! সম্প্রচার করতে করতেই নজরুল লিখে চলেছেন একের পর এক এলিজি। আকাশবাণী থেকে দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় রেডিওতে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর শোকার্ত, বিহ্বল, মন্দ্রকণ্ঠ---"ভারতভাগ্য জ্বলিছে শ্মশানে, তব দেহ নয় হায়,/আজ বাংলার লক্ষ্মীশ্রীর সিঁদুর মুছিয়া যায়...

অভূতপূর্ব সেই মহাযাত্রার বিবরণ আজও হয়তো সংরক্ষিত আছে আকাশবাণীর আর্কাইভে, সংরক্ষিত আছে প্রত্যক্ষদর্শী কিছু অতিপ্রবীণ মানুষের স্মৃতিতে আর বঙ্গসাহিত্যের কিছু অবিস্মরণীয় লেখকের রচনায়। মৈত্রেয়ী দেবী, সন্তোষ কুমার ঘোষ আর বুদ্ধদেব বসুর লেখায় লিপিবদ্ধ আছে সেদিনের কিছু খণ্ড মুহূর্ত। তেমনি এক উদ্ভাসিত মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারি আমরা সত্যেন আর স্বাতীর সঙ্গে বুদ্ধদেবের তিথিডোর উপন্যাসে---

"আসছে … আসছে …’ গুঞ্জন রব উঠলো ভিড়ের মধ্যে।

স্বাতী মনে-মনে ভাবছিলো লম্বা গম্ভীর আনত আচ্ছন্ন স্তব্ধ মন্থর মিছিল, কিন্তু মাত্রই কয়েকজন যেন অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে নিয়ে এলো কাঁধে করে – নিয়ে গেলো উত্তর থেকে দক্ষিণে – পিছনে এলোমেলো লোক – বিদ্যুতের ঝিলিক দিলো লম্বা শাদা চুল আর মস্ত শাদা শান্ত তন্ময় কপাল। ঐটুকু দেখলো স্বাতী, আর দেখতে পেলো না।

সত্যেন দেখলো, স্বাতী দাঁড়িয়ে আছে শক্ত সোজা হয়ে, হাত মুঠ করে, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, দেখলো তার কন্ঠের কাঁপুনি, ঠোঁটের কাঁপুনি, গালের ঘন রঙ, দেখলো তার তরল কালো উজ্জ্বল চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল হলো, ঝকখকে দুটি আয়না হয়ে উঠলো, তারপর ভাঙলো আয়না, আবার তরল হলো, উপচালো, মাথা নিচু হলো।

আর তা-ই দেখে সত্যেনের নতুন করে গলা আটকালো, চোখ ঝাপসালো, আর সেজন্য লজ্জা করলো নিজের কাছেই। এ মৃত্যু তো কান্না চায়না, এই দুঃখ মহান, মহামূল্য দুঃখ, আশি বছরের পরম পরিশ্রমের এই সবশেষের রত্ন – এ কি চোখের জলে বাজে খরচ করবার?"

মহার্ঘ বেদনার এই সম্পন্ন উত্তরাধিকার, যা হয়ে ওঠার কথা ছিলো আমাদের মতো উত্তরসাধকদের কাছে এক বহুমূল্য দীক্ষা, আজ তাঁর মৃত্যুর পঁচাত্তর বছর পরে, তার পরিণাম দেখে বড়ো শঙ্কা জাগে। অনুভব করি বড়ো মর্মান্তিক ঋতকথন ছিল বিষ্ণু দের সেই মর্মান্তিক কবিতা--

"কালবৈশাখীর তীব্র অতৃপ্ত প্রতিভা 
বাদলের প্রবল প্লাবন--
সবই শুধু বৎসরান্তে একদিনে নির্গত নি:শেষ? 
অপঠিত, নির্মনন, 
নেই আর কোনো আবেদন!!"...
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ 
আর বাইশে শ্রাবণ?"

আজ বড়ো দরিদ্র হয়ে পড়েছি আমরা, উত্তরাধিকারহীন, আত্মপরিচয়হীন, "আপন সত্তার থেকে পলাতক", "নিত্য রুচিক্ষয়ে ক্ষয়ে অসুন্দর"। আমাদের এই "গড্ডল ধুলার অন্যায়ে কুৎসিতে" "সেই সাবিত্রীর ক্ষিপ্র কর বিভা" প্রতিদিন আজ ম্রিয়মান। অথচ, এমন হওয়ার কিন্তু কোনও কথা ছিল না। ব্যাস-বাল্মীকি-কালিদাসের সম্পন্ন উত্তরাধিকার আছে আমাদের, আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগেও তিনি বেঁচে ছিলেন শারীরিক ভাবে, সেই তিনি যিনি আমাদের পরম সৌভাগ্যবশত এই হতশ্রী দেশে জন্মগ্রহণ করে একটি দেশকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন শীলিত রুচি, অনম্য আভিজাত্য আর গরিমাময় এক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অহংকার। অথচ, দুর্ভাগ্য এই যে তাঁকে আমরা আত্মস্থ করতে পারলাম না। চৈত্রের শালবনের নিভৃতিতে আমার তাঁকে খুঁজলাম না। যিনি আমাদের প্রতিষ্ঠা হতে পারতেন, তাঁকে নিয়ে আমরা প্রতিষ্ঠান বানালাম। তাঁর আলো আর আকাশ, যা হতে পারতো আমাদের পরিত্রাণ ও মুক্তি, তার বদলে আমরা তাঁর মূর্তি বানালাম, উৎসব করলাম, কিন্তু আমাদের অন্তরে পরিগ্রহণ করলাম না। জীবন যে আসলে কীভাবে যাপন করতে হয়, সব পৃথুলতাকে অতিক্রম করে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কীভাবে পুণ্য করতে, হয়, ধন্য করতে হয়, আলোকশিখা করে তুলতে হয় দেবালয়ের--জীবনের সেই মহার্ঘ পাঠটি-ই তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করা হলো না আমাদের।

আজও বাইশে শ্রাবণ আসে, এবারেও আসবে, যেমন আসে প্রতিবার। হয়তো শ্রাবণের ঘনকৃষ্ণ মেঘ সেদিন পুঞ্জিত হয়ে থাকবে আকাশে। সেদিন যেন আমরা স্মরণে রাখতে পারি তাঁর গান--"এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে"; আমরা যেন ভুলে না যাই মেঘ নয়, বৃষ্টিও নয়, মেঘের ভিতরে নিহিত সেই জ্বলদর্চি শিখাটির নাম আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিন নতজানু হয়ে আমরা যেন প্রার্থনা করতে পারি---

"তোমার আকাশ দাও কবি, 
দাও দীর্ঘ আশি বছরের 
আমাদের ক্ষীয়মান মানসে ছড়াও 
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো…” 

প্রার্থনা করি, বাইশে শ্রাবণোত্তর আমাদের দিনগুলি জ্যোতির্ময় হোক, প্রার্থনা করি, গানে গানে আমাদের সব বন্ধন ঘুচে যাক্।


7 comments:

  1. কোনো কথা হবে না হিমাদ্রিদা। অ সা ধা র ণ।

    ReplyDelete
  2. কোনো কথা হবে না হিমাদ্রিদা। অ সা ধা র ণ।

    ReplyDelete
  3. ভীষনই ভাল লাগল। কেন যে আরও বেশি বেশি লেখেন না।

    ReplyDelete
  4. ভীষনই ভাল লাগল। কেন যে আরও বেশি বেশি লেখেন না।

    ReplyDelete
  5. সুন্দর রচনা

    ReplyDelete
  6. আলপনা ঘোষ22 July 2016 at 11:54

    চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম পুরো দৃশ্য।আমাদের ৩৬৫ দিনের জীবনে প্রতি নিয়ত তাঁকে অনুভব করি, তাঁর অস্তিত্ব আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। তবু আপনার লেখা পড়ে চোখ জলে ভেসে গেল।

    ReplyDelete