অণুগল্প - সুবর্ণা রায়



অণুগল্প


নিহারী আর মিতুমা
সুবর্ণা রায়



ভিতরটা শুকিয়ে আসছে টের পাচ্ছেন মিত্রা। একটা অমোঘ কালো ছায়া চুপিচুপি এগিয়ে আসছে। দূরত্ব কমে আসছে ক্রমশ। উপন্যাসটার শেষ লাইনটা লিখে পেনটা বন্ধ করলেন। ক্লান্তির থেকেও তৃপ্তি হচ্ছে অনেক বেশী। অনেক কাজ বাকি ছিল, শেষ করেছেন একে একে।

নিহারী টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একমনে পড়ছিল কিছু। পেনের ক্লিকের সামান্য আওয়াজে, মুখ না তুলেই বলল, ‘‘হল তোমার নায়িকার জয়? এবার তো একটু ঘুমাও! এগারোটা বেজে গেছে।’’

ভারী পর্দার গাম্ভীর্য যেমন আটকাতে পারে নি পূর্ণিমার আলো, নিহারীর নির্লিপ্ততা কিছুতেই ঢাকতে পারে না ওর স্নেহ, মায়া, মমতা। মিত্রা জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখলেন আর একবার। মন ভরে দেখলেন। চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে, চশমাটার আড়ালে দীর্ঘ চোখের পাতা রিসার্চের একতাড়া কাগজকে দুষছে নিশ্চয়ই কাজলকালো চোখকে কষ্ট দেবার জন্য। হাসলেন মিত্রা। ঠিক যেরকম হাসলে মনে হয় মনের মণিকোঠায় না পাওয়ার দুঃখগুলোয় ছাতা পড়ে গেছে, ভেসে আছে শুধু শরতের ভোরের শিউলির গন্ধের মত সুখ...

দুদিন কাজে আসে নি সন্ধ্যা। একবার খবর নেবে কি না গিয়ে ভাবছে মিতু, ড্রাইভার লক্ষ্মণ এসে খবর দিল, সন্ধ্যার জ্বর। মাঝেমাঝেই জ্বর হচ্ছিল। এবার একেবারে পেড়ে ফেলল। মিতু দাঁতে নখ কাটছিল চিন্তায়, লক্ষ্মণ বলল, ‘‘আপনাকে একবার যেতে বলেছে গো মা। যদি পারেন আজই।’’

মিতুর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল সন্ধ্যা। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। চোখের অবিশ্রান্ত জলের ধারা মুছিয়ে দিয়েছিল মিতু। কাতর ভাষাটা পড়েছিল। সন্ধ্যার এত বছরের কষ্টার্জিত রুক্ষতাকে নিজের উষ্ণতা দিয়েছিল। একসময় নিথর হাতটা ছেড়ে আর একটা ছোট হাত ধরে বাড়ি ফিরে এসেছিল অনেকটা শূন্যতা নিয়ে।

কাস্টডি নিয়েছিল আইনি মতে। নিহারী তখন ছয়। বুঝত হয়তো অনেক কিছুই। চুপ করে থাকত। মিতুও একটু এড়িয়ে চলত। একটা অস্বস্তি ছিল কোথাও। অনেকটা দূরত্ব পেরোতে কিছুটা সময় তো লাগারই ছিল...

মিত্রা চোখ বুজে আছেন। ঠোঁটে আলতো স্বর্গীয় হাসি। ডান হাতটা ভাঁজ করে পেটের ওপর রাখা। নিহারী ডাকছে, ‘‘মিতুমা, তুমি ঘুমোলে মিতুমা?’’ ঝরণার মত বাজছে স্বরটা কানে, মিত্রা আল ধরে দৌড়চ্ছেন, খালি পায়ে শিশিরের ঠাণ্ডা, হাসছেন আর হাসছেন, পিছনে ছোট্ট নিহারী দুই বেণী দুলিয়ে দৌড়ে ধরতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কপট রাগ দেখিয়ে ডাকছে, ‘‘মিতুমাআআআ, আমার কিন্তু পেটে ব্যথা করছেএএএ...’’

মিত্রা ঘুরে দাঁড়ালেন। একটু দূর থেকে দেখছেন, নিহারী ঝুঁকে পড়েছে মুখের ওপর। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে হাত ধরে ঝাঁকাচ্ছে এবার। 

উনিশ বছর আগেও বোঝেননি মিত্রা, এখনো বোঝেন না, সেদিন কে কাকে বাঁচিয়েছিল।


No comments:

Post a Comment