ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব



ধারাবাহিক

আমার বারুদ-বেলা - ১১
স্বপন দেব



ভিয়েৎনামের লড়াকু প্রতিরোধের সমর্থনে এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় যে আপাত নিরীহ মিছিলটি হেদুয়া থেকে বেরিয়েই পুলিশের ঘিরে নেওয়া, লাঠিচার্জ আর পরিশেষে লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপে এসে বিলীন হওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে বলেছিলাম যে সেখানে এক মজার এবং রোমাঞ্চকর কাহিনী আপনাদের শোনাব। বেশ কিছু মহিলা সমেত প্রায় শ আড়াই জনকে ট্রাকে করে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল। নিয়ম হল পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে কোর্টে তুলতে হবে। একটি গোটা নিরীহ মিছিলকে লাঠিচার্জ করে মেরে তুলে নিয়ে এসে আদালতে পেশ করলে সেটা যে নিন্দনীয় হবে এবং বিচারক সবাইকে জামিন দিয়ে দেবেন এটা পুলিশ জানতো। তাই শুরু হল বাছাইয়ের পালা। প্রথমে মহিলারা। পাঁচজন করে মহিলাকে ডেকে নিয়ে এসে নামধাম, বাড়ির ঠিকানা লিখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল। প্রায় জনা কুড়ি মহিলার মধ্যে মাত্র দুজনকে আটক করে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হল। এবার আমাদের পালা। আর এখানেই মজা আর রহস্য! পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জে শুধু যে আমরাই আক্রান্ত হয়েছিলাম তা কিন্তু নয়। অনেক নিরীহ পথচারীকেও লাঠিপেটা করে লালবাজারে নিয়ে আসা হয়েছিল। ট্রাকে করে আমাদের লালবাজারে নিয়ে আসার সময় থেকেই একটি কম বয়েসি ছেলে খুব কাঁদছিল। কাঁদছো কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে সে জানালো যে সে তাদের দোকানে যাচ্ছিল। এই মিছিলের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। আমি বুদ্ধি করে তার নাম, বাবার নাম, দোকানের নাম আর বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে তাকে বললাম, তুমি একদম পেছনে গিয়ে বোস। আমাদের ধরে রাখা হয়ে গেলে তোমাকে ছেড়ে দেবে। ছেলেটি পিছনে চলে গেল, আমি একদম সামনে চলে এসে বসলাম আর মনে মনে নামতার মত ছেলেটির দেওয়া তথ্যগুলি মুখস্থ করতে লাগলাম। আরো গোটা পনেরোজনের পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল জেরার জন্যে। আমি তো গিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম, আমাকে কেন ধরলেন স্যার? আমি তো আমাদের দোকানে যাচ্ছিলাম। ওই রকম সবাই বলে। তোদের দোকানের নাম কি? আমি বললাম পিকটো প্লেস। নাম, বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা বল। মুখস্থ করা তথ্যগুলো গড়গড়িয়ে বলে গেলাম। ওরা একটা লিস্টে আমার নাম খুঁজে না পেয়ে বলল, সত্যি বলছিস? আমি আবার কেঁদে কেঁদে বললাম, বাড়িতে ফোন করে দেখুন না স্যার। ওরা সত্যিই ফোন করল। তখন তো আর মোবাইল ছিলনা। সবই ল্যাণ্ড লাইন। যাই হোক ওপাশ থেকে ছেলেটির বাবা বা দাদা কি বলেছিলেন আমি জানিনা, কিন্তু ওরা আমাকে বলল, তোকে ছেড়ে দিলে এত রাতে বাড়ি যেতে পারবি? তখনো রাত বারোটা বাজেনি। আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার, এইতো এইটুকু রাস্তা। ঠিক চলে যাবো। যা, আর শোন, এরপর থেকে আর কোনওদিন পুলিশ দেখে ছুটবিনা।

বাইরে এসে দেখলাম তুমুল বৃষ্টি চলছে। আমার দেহ তখন পরিশ্রান্ত, আহত। মনে আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকগুলো প্রশ্ন। ঠিক কতক্ষণ সময় পাবো আমি? সমীর পাল নামে পিকটো প্লেসের ঐ যুবক কে ডেকে পাঠালেই তো আমার জারিজুরি শেষ! আর স্বয়ং রুনু গুহ নিয়োগী দেখে গেছেন আমায়! এই সব ভাবতে ভাবতেই আমি ঐ বৃষ্টি মাথায় করে হাঁটা দিলাম বৌবাজারের দিকে। পকেটে আছে মাত্র দশটি টাকা। বৌবাজারের মোড়ে এসে দেখা পেলাম এক শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভারের। উনি ভবানিপুরের দিকে গাড়ীর মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন। গ্যারেজে ফিরবেন বলে। আমি সব বলে উনাকে অনুরোধ করায় উনি রাজি হলেন এবং আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। আমি যেখানে ছেলেটিকে বসিয়ে এসেছিলাম তাতে তার টার্ম আসতে আরও প্রায় একঘন্টা। তারপরে তার বদলে কে পুলিশকে ধোঁকা দিল এটা জানতে প্রায় আরো আধঘন্টা এবং তারপরে পুলিশের অ্যাকশন নিতে প্রায় আরও আধঘন্টা। এই মোট দু ঘন্টা সময় আমার হাতে আছে। এর মধ্যেই আমাকে যা করার করতে হবে। বাড়ি এসে আরেক বিপত্তি। আমাদের যেসব ছেলেরা মিছিল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা ইতিমধ্যেই আমার মাকে আমার গ্রেফতার হওয়ার খবর শুনিয়ে গেছেন। আমি যত জোরেই দরজা ধাক্কাই না কেন, মা পুলিশ ভেবে কিছুতেই দরজা খোলেন না। শেষে প্রাণপণ চিৎকার করে, “মাআআআ, মাআআআ” করে চেঁচাতে লাগলাম। আশেপাশের বাড়ির জানালায় কিছু উৎসুক দৃষ্টির মধ্যে মা এসে দরজা খুললেন অবশেষে! আমার আধা ঘন্টা এখানেই শেষ। এরপরে, জামাকাপড় পালটানো, রাতের খাওয়া, অন্তত ১০/১৫ দিনের জন্যে জামাকাপড়, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র, এবং মার কাছে বেশ কিছু টাকা ধার করতেই কেটে গেলো আরো চল্লিশ মিনিট। এবার যেতেই হবে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত পৌনে দুটো। কিন্তু কোথায় যাবো? বাইরে তখনোতুমুল বৃষ্টি চলছে। আর আকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মা অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে। এবার বেরোতেই হল। একটা আধ-ছেঁড়া উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রেনকোট ছিল আমার, সেটা গায়ে দিয়ে মাকে একটা প্রণাম করেই নিঃশব্দে সাঁৎ করে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলাম।

এতক্ষণ যেটা মাথাতেই আসেনি, বাড়ি থেকে বেরোতেই সেটা মাথায় এলো! আরে, আমার বাড়ির ১০০ ফুটের মধ্যেই তো রয়েছে আমার এক নিরাপদ, বিশ্বস্ত ও গোপন আস্তানা। এর আগে অবিশ্যি আমি এখানে কোনওদিন রাত্রিবাস করিনি। কিন্তু আজকের রাতের জন্যে এর চেয়ে ভালো ডেরা খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমার বাড়ি থেকে একটু এগোলেই শোভাবাজার রাজবাড়ি(বড় তরফ)। বাড়িটি তখন জরাজীর্ণ। বাড়িটির শেষের দিকে এক তলায়, রাস্তার ওপরেই বেশ বড়ো আর লম্বাটে সাইজের দুটো ঘরে থাকতো বিহারী রিকশাওয়ালারা। এর মধ্যে একটি ঘরের মালিক বা ভাড়াটে ছিল রামজী। আমাদের পাড়ার সামাজিক অবস্থানটা এই প্রসঙ্গে একটু বলে নেওয়া দরকার। এটি ছিল একটি অভিজাত বনেদী পাড়া। আর ওরা, মানে ঐ রিকশাওয়ালারা হল ছোটোলোক। তাই ওদের দিকে কারোরই তেমন নজর ছিলনা। আর প্রকৃতির আশীর্বাদে একটি ঝাড়ালো নিম গাছ ঘর দুটিকে সবার নজরের আড়ালে রেখে দিয়েছিল। ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে ভেবে এই রামজীর সঙ্গে আমার এক বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। আমার বেশ কিছু গোপন নথি-পত্রও রাখা ছিল এই রামজীর জিম্মায়। এই রামজীই আমার সে রাতের উদ্ধারকর্তা। ঘরে ঢুকে ৭/৮ জন লোকের মধ্যে খুঁজে রামজীকে বললাম, আজ আমি তোমাদের সঙ্গে শোবো। রামজী নকশাল কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিল আর আমি যে একজন নকশাল, সেটাও ও জানতো। ও বুঝে গেল যে কুছ গড়বড় হ্যায়! নিজে ড্যাম্প ধরা দেওয়ালের স্যাঁৎসেঁতে মেঝেতে চট বিছিয়ে আমাকে ওর খাটিয়াটা ছেড়ে দিল। মজার ব্যাপার হল যে এই ঘর দুটিকে আমরা বলতাম রিকশা খাটাল। আমাদের বাবা কাকারাও তাই বলতেন আর এখনকার ছেলেমেয়েরাও তাই বলে। কিন্তু, কালের অমোঘ নিয়ম এড়িয়ে, শোভাবাজার রাজবাড়ির ঐ অংশটুকুতে প্রোমোটার থাবা বসালেও সেই ঘর দুটি কিন্তু এখনো আছে!

সারাদিনের ক্লান্তি, লাঠিপেটার যন্ত্রণা, বৃষ্টিতে ভেজা আর সর্বোপরি কাল কোথায় যাবো, এই সব ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ঘুম ভাংলো ভোর পাঁচটায়, রামজীর ডাকে। বাবুদা, পুলিশ আয়া! রামজীকে এর আগে যতবার বলেছি আমার নাম ধরে ডাকতে, ও কানে হাত দিয়ে বলেছে, উও হম নহি সকেঙ্গে বাবু! অনেক বুঝিয়ে এই বাবুদা তে আসা!পুলিশ যে আসবেই এটা তো জানাই ছিল! কিন্তু এত পরে? কোথায় এসেছে পুলিশ? আমার প্রশ্নের জবাবে রামজীর উত্তর, আপ কি কোঠিমে। আমি হেসে বললাম, তোমরা সকালে উঠে রোজ যা যা কর, আজও তাই করো। ভয় নেই। পুলিশ আসবেনা এখানে। আসেনি পুলিশ রামজীর ডেরায়। সকাল নটায় উঠে জানলাম। তবে আমার বাড়িতে ছিল ঘন্টা দুই। রামজীকে আমার মা বিলক্ষণ চিনতেন। কারণ তখন আমাদের কোনও গাড়ি ছিলোনা। মায়ের ভরসা ছিল মূলত রিকশা। আর আমার সঙ্গে সুপরিচিত হিসেবে অধিকাংশ সময়ে হয় রামজী নয় তার ঠিক করে দেওয়া কোনও অন্য রিকশাওয়ালা ছিল তাঁর বাহক। তবে এই খুশখবর শুনে কিন্তু আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল আর গতরাতে বৃষ্টিতে ভেজার পরেও সুস্থ আছি দেখে আরও আনন্দ হল। আর খুব জানতে ইচ্ছে করছিল আজ ভোরের পুলিসি অভিযানের ইতিবৃত্তান্ত। পাক্কা ক্রিমিন্যাল আর ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট-এর অফিসারদের মধ্যে যেমন এক বুদ্ধির লড়াই চলে, আমার মত পোড় খাওয়া নকশাল আর লালবাজারের রুনু গুহ নিয়োগী সহ সকলের মধ্যেই চলত এক বুদ্ধির লড়াই। তাবলেআমাকে একজন ক্রিমিন্যাল ভেবে নেবেন না প্লিজ! আপনারা বরং অনায়াসে আমাকে একজন সমাজ-বিরোধী বলতেই পারেন। কারণ আমি সত্যিই এই সমাজব্যবস্থার বিরোধী ছিলাম।এখনও আছি!

সে যাই হোক, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে লালবাজার আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্যে বেশ কয়েক জন পর্যবেক্ষণকারী মোতায়েন করে রেখে গেছেন আমার বাড়ির সামনে। কারণ আমার মততাঁরাও জানেন যে সেই বৃষ্টির রাতে, অত নিশীথে আমার পক্ষে দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়।

আমাদের বাড়ির এক কাজের মাসি আনন্দ লেন থেকে আসতো সকালে । আনন্দ লেন থেকে আসতে গেলে তাকে ঐ রামজীর রিকশা খাটাল পেরিয়েই আসতে হত। আর ফিরেও যেত ঐ একই পথে সকাল দশটা নাগাদ। তার বাড়ি আমি চিনতাম এবং সেটাও রামজীর খাটাল থেকে বড়জোর ২০০ ফিট। রামজীর ঘরে শুয়ে শুয়েই আমি তাকে ফিরে যেতেও দেখলাম। এবং আমার আশা ও আশঙ্কা মত এক খোঁচর বা সাদা পোষাকের পুলিশ তাকে অনুসরণ করছেও দেখলাম! এদের চেনার খুব দুটি সহজ উপায় আমরা বার করে ফেলেছিলাম। প্রথমত, এরা ধুতি নাহয় প্যান্ট পড়লেও চটি না পড়ে বুট পড়তো। আর দ্বিতীয়ত, এরা সবসময়েই তোমাকে ফলো করবে তোমার বাঁ দিক থেকে। কারণ, ডান দিকে ঘাড় ঘোরানো যত সহজ, বাঁদিকে নয়। সে যাই হোক, আমি বুঝে গেলাম যে এ যাত্রায় আর মায়ের সঙ্গে দেখা হচ্ছেনা। কিন্তু যাবো কোথায়? ইতিমধ্যেই ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। সিপিএম একক গরিষ্ঠতা পেলেও বাংলা কংগ্রেস এবং সিপিআই-এর বিধায়কদের নিয়ে গঠিত হয়েছে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট এবং যার মুখ্যমন্ত্রী আবার সেই অজয় মুখার্জি। পশ্চিমবঙ্গে তখন নকশালবাড়ির আন্দোলনের ঢেউ তরাই ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, দূরে দূরান্তরে... এই কলকাতাতেও। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টে সি পি এম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে এক নতুন উপদ্রব। নকশাল-সিপিএম সঙ্ঘর্ষ। কেউ কারোর থেকে কম যায়না। মোটামুটি এই সময় থেকেই সিপিএম এবং নকশাল এই দুটি পার্টিতেই ঢুকে পড়ে সমাজ-বিরোধীরা। তাই তখন আমদের শত্রু ঘরে সিপিএম আর বাইরে পুলিশ! শাসক দল হওয়ায় সিপিএম ক্যাডারদের কিন্তু তখন আর পুলিশী অত্যাচার সইতে হচ্ছেনা। কিন্তু নকশালপন্থীদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে দু তরফকেই। এই রামজীর ঘরের মতন কলকাতায় আমার আরও বেশ কয়েকটি গোপন আস্তানা ছিল। কিন্তু সিপিএম-এর জন্যে সেগুলি তখন আর নিরাপদ নয়। তাই আমাকে পালাতে হবে কলকাতার বাইরে। এমন কোনও জায়গায় যেখানে কেউ আমাকে চেনেনা অথচ নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের গ্যারান্টি আছে। পথ-নির্দেশ জানিনা, কিভাবে যাবো তাও জানিনা। শুধুমাত্র পোস্টাল ঠিকানাটুকু জানি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই মেয়েটির কথা।নীলরতন সরকার হাসপাতালে থাকার সময়ে মেয়েটি ছিল শেষ বর্ষের নার্সিং ছাত্রী। পরে পাস করে বীরভূমের লোহাপুর বলে একটি গ্রামীণ হাসপাতালে আছে এবং তার নিজস্ব কোয়ার্টার আছে। চিঠিপত্রের মাধ্যমে এটুকুই জানা ছিল আর ছিল তার আগাম আমন্ত্রণ, “যখনই ইচ্ছে হবে চলে আসবেন কিন্তু!”

শুধু এই আন্তরিক আহ্বানটুকুকে আর আমার নিরুপায়তাকে সম্বল করে আমার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, “চলো লোহাপুর!” রামজীরা কঠোর পরিশ্রম করে। কিন্তু তাদের দৈনন্দিন আহারে প্রোটিনের পরিমাণ খুব কম। এরা সেটাকে ম্যানেজ করে কার্বো-হাইড্রেট দিয়ে। রামজীর খাটালের মেনু আমার জানা ছিল। জনাপ্রতি সাড়ে তিনশ গ্রাম চালের ভাত, ৩০ গ্রাম ডাল আর ১৫০ গ্রাম আলুর চোখা। এমনিতে ওদের খাওয়ার সময় সকালের রিকশার শিফট শেষে দুপুর দেড়টা নাগাদ। কিন্তু আমি রামজীকে বলেছিলাম যে আমি দুপুর সাড়ে বারোটায় বেরিয়ে যাবো। ঠিক দুপুর বারোটায় ঐ খাটালের সব রিকশাওয়ালা এক ঘন্টা আগেই তাদের সওয়ারি প্রত্যাখ্যান করে সেখানে হাজির হয়ে গিয়েছিল আমার সঙ্গে মধ্যাহ্ণভোজ করবে বলে! রামজীর খাটালের ঠিক পাশের ঘরেই ছিল আরেকটি খাটাল যাকে আমরা জানতাম টুলুর খাটাল বলে। তাদের সঙ্গে আমার খুব একটা মিলমিশ ছিলনা। আমি জানতামও না যে ঐ খাটালে রিকশাওয়ালাদের সাথে দু তিনজন বিহারি ট্যাক্সি ড্রাইভারও থাকে এবং দুপুরের খাওয়ার সময়ে তারা ফিরে আসে এখানে। তাই রামজীকে যখন বললাম একটা ট্যাক্সি ডেকে দিতে, ও বলল আর মিনিট পনেরো কুড়ি পরেই পাশের টুলুর ঘরের ট্যাক্সি ড্রাইভাররা খেতে আসবে। এদেরই একজনের ট্যাক্সিতে সওয়ার হয়ে আমি প্রথমে গেলাম হাওড়া স্টেশন। সেখানে শুনলাম যে লোহাপুর যেতে হলে আগে আমাকে নলহাটি যেতে হবে। সেখান থেকে গাড়ি পালটে যেতে হবে লোহাপুরে। আমি যখন লোহাপুরে নামলাম, তখন রাত তিনটে কি সাড়ে তিনটে হবে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পরা শুরু হয়েছে আবার। স্টেশনমাস্টারের ঘরে একজন লোক বসেছিল যে সিগন্যাল দেখায়। তাকে জিগ্যেস করলাম লোহাপুর হাসপাতাল কতদূরে আর সাইকেল রিকশা কখন পাওয়া যাবে? উত্তরে শুনলাম হাসপাতাল স্টেশন থেকে প্রায় তিন মাইল আর সাইকেল রিকশা এখানে চলেনা। অন্যসময়ে গোরুর গাড়ি পাওয়া গেলেও এখন সেটাও পাওয়া যাবেনা, কারণ বৃষ্টিতে মাটি এতটাই নরম হয়ে গেছে যে গাড়ির চাকা বসে যাবে। তাহলে উপায়? সে বলল, লাইন ধরে হেঁটে যান সোজা। এখন আর কোন ট্রেন নেই এই লাইনে। অন্ধকারে, মাথায় বৃষ্টি নিয়ে আমি রেল লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। (চলবে)

16 comments:

  1. খুব ভাল লাগল। আগ্রহ তৈরী হল পরবর্তী পর্বের জন্য।

    ReplyDelete
  2. মুগ্ধ । পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়...

    ReplyDelete
  3. উপরি পাওনা হিসেবে আগের কিস্তিটাও পেয়ে গেলাম!! সত্যি, কি জীবন ছিল আপনাদের! শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

    ReplyDelete
  4. রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেলাম!! আপনাদের প্রজন্মকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা।

    ReplyDelete
  5. ভালো লাগছে...মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব দিনের কথা!

    ReplyDelete
  6. এর আগের কিস্তিগুলি না পড়া অবধি শান্তি নেই!! ওসম্ভব উত্তেজনায় ভরা টান টান লেখা!!

    ReplyDelete
  7. নকশাল আন্দোলন আমার জন্মের আগের কথা। কিন্তু আপনার কলমে সেই আন্দোলনের যে রুপ রেখা ফুটে উঠেছে, তা অতুলনীয়!!

    ReplyDelete
  8. মুগ্ধ হলাম! খুব ভালো লেখা!

    ReplyDelete
  9. 😊😊😊😊😊☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺☺

    ReplyDelete
  10. গা ছম ছম করা লেখা! রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেলাম! পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  11. বার বার পড়ার মত লেখা।

    ReplyDelete
  12. এক সাথে পুরোটা পড়তে চাই !

    ReplyDelete
  13. পরের পর্ব নিশয় আরো রোমাঞ্চকর হবে!!

    ReplyDelete