ছোটগল্পঃ সংযুক্তা মজুমদার



ছোটগল্প

ইন্টারভিউ 
সংযুক্তা মজুমদার



সে সময়টা একদম আলাদা ছিল। ষাট দশকের শেষের দিকে, নানা ধরনের লোকজন, হরেক ফুলের সমাহারে সেজে ওঠা ব্যাণ্ডেল শহর। শ্বশুরমশাই, স্বামী, দুই ছেলে, বাড়ির মালী হরগৌর, দারোয়ান শিউনাথ আর রাতদিনের কাজের মাসি লক্ষ্মী কে নিয়ে কল্যাণীর সংসার ছিল। ছেলেরা কেউ এখানে থাকেনা, বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, হল্যান্ডে থাকে, আর ছোটটার জন্য সারা বিশ্বই বাড়ি। সে ভাষাবিদ, রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাজে আজ এই দেশ, কাল ওই দেশ। বলা নেই কওয়া নেই যখন তখন হাজির হয়। দুদিনের জন্য হলেও বাড়ি মাতিয়ে দিয়ে যায়।কল্যানীরাও কলকাতায় চলে এসেছেন। অলস শীতের দুপুরে পুরনো এ্যালবাম এর পাতায় চোখ আটকে গেল আর মন ফিরে গেল সোনালী দিনে...

কিরিং কিরিং... সাইকেল রিকশার আওয়াজ হতেই পড়িমড়ি করে তিন বছরের টিঙ্কু ছুটল। হাতে একটা হলুদ রঙের হাওয়াই চটি। মা পিছন থেকে ডাকছেন, “টিঙ্কাই, আজ দেরি হয়ে গেছে... আজ যেওনা, দাদার স্কুলের দেরী হয়ে যাবে...।’’ কিন্তু ততক্ষণে টিঙ্কাই রিক্সায়। “ফলিদদা, ছিগিল চল, চল, চল!” ফরিদও ছোটবাবুর হুকুম তামিল করে সেই চত্তর থেকে হাওয়া। 

বেশ কিছুক্ষণ পরে টিঙ্কু বাড়ি ফিরল। দাদা ততক্ষণে স্কুলে পৌঁছে গেছে, বাবার গাড়ি চেপে। মা গম্ভীর মুখে রান্নাঘরে কাজ করছেন। টিঙ্কু জানে, মা বকবেন, আবার আদরও করবেন। খিদে পেয়েছে, তাই চুপটি করে সে খাবার টেবিলের কাছে রাখা তার নিজের ছোট চেয়ারে গিয়ে বসল। দাদু এসে বসতেই মা জলখাবার নিয়ে এলো। দাদু টিঙ্কুকে জিজ্জেস করলেন, “কি দেখলে দাদুভাই? আজ ফরিদদা তোমায় কি দেখাল?” সাথে সাথে টিঙ্কু বলে উঠল, “দেতলাম, ছেনতান পানকে নান নান ফুন ফুতেছে। নোকেলা পালকেল পাতে তা খাত্তে। ব্যাত, আল কিতু দেতিনি।” দাদু হাহা করে হেসে উঠতেই টিঙ্কু বিরক্ত হল। তিন বছর হলে কি হবে, আত্মসম্মান বোধ তার প্রবল।

রোজই বাবা বাড়ি ফেরেন, হাত মুখ ধুয়ে, কিছু খেয়ে দাদাকে নিয়ে বসেন। স্কুলে কি হল, কি পড়া আছে কালকের, ইত্যাদি। টিঙ্কুর মোটেই ভালো লাগেনা। বাবা মাঝে মাঝে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “কি টিঙ্কুবাবু, কি খেলছ তুমি আজকাল?” টিঙ্কুর ভালো লাগেনা। ও কি খালি খেলে? ও যে লুকিয়ে দাদার বই সব পড়ে ফেলে তার খবর কি কেউ রাখে? রোজ দুপুরে দাদা স্কুল থেকে বাড়ি এলেই টিঙ্কু দাদার টিনের সুটকেসটা নিয়ে বসে। সব বই খাতা খুলে খুলে দেখে। কত ছবির বই, দাদা কত ছবিও আঁকে, একটু লেখাও থাকে তাতে। কিন্তু এ আর এমন কি, ভাবে সে, এ তো আমিও পারি। কিন্তু মা বাবা টিঙ্কুকে স্কুলে ভর্তি করছেননা। খালি বলেন, ‘‘এখনও তোমার বয়স হয়নি টিঙ্কু।’’

টিঙ্কু বড় হচ্ছে, আর সারাদিন বাড়ির দারোয়ান, মালী, ঠাকুর, সবার সাথে ঘুরে ঘুরে তার ভাষার উপর অসাধারণ দখল তৈরি হচ্ছে। দারোয়ান শ্যামলালের কাছে, “ও ভাইয়া, তনিক খৈনি দেও’’, মালিদাদার কাছে, ‘‘ছোটবাবু, ফুলে হাত দেয়নে কো বটে’’, ইত্যাদি নানা ধরনের ভাষা তার তিন বছরের মাথায় বাসা বাঁধছে। এমন সময় বাড়িতে এলেন এক আম্মা। বাবার পিসিমা। টিঙ্কুর তো পোয়া বারো। আর একজন বন্ধু বাড়ল তার। 

সারাদিন টিঙ্কু আম্মার গায়ে লেপটে থেকে একদম কাঠ বাঙ্গাল ভাষা অনায়াসে রপ্ত করে ফেলেছে। একদিন সকালে যখন দাদু রোজকার মতনই জিজ্ঞেস করলেন, “দাদুভাই, আজ কি দেখলে?” টিঙ্কু খুশি হয়ে বলল, “দাদু, আজ না অনেকগুলি মুরগীর ছাওয়াল দেখসি, সারাটা রাস্তা জুইড়া অগো কি খেলা। খুব খুশি হইসি এইডা দেইখ্যা।” দাদুর মুখে একটুও হাসি এলনা। গম্ভীর হয়ে কল্যানীকে বললেন, “টিঙ্কুর স্কুলে ভর্তির সময় হল বউমা। এখন যদি ও সঠিক বাংলা বা ইংরেজি না বলে বাঙ্গাল বলে তবে তো রক্ষা নেই।” 

কল্যানীর মুখ ভার হল। সে কি করবে? পিসিশাশুড়ির বাঙ্গাল কথাকে ইংরেজী করবে কি করে? এদিকে শব্দ ভাণ্ডার ‘সাওয়াল’ থেকে ‘সেটাইসে’ অবধি পৌঁছে গেছে। এমন সময় একদিন বাড়িতে আমেরিকা থেকে টিঙ্কুদের মেজকা এলেন, সাথে মেম বউ আর সোনালী চুলের দুধসাদা ক্লোয়ী। সারাদিন ক্লোয়ী আর টিঙ্কু ফেভিকলের মত জুড়ে আছে। পরের দিন ক্লোয়ী যাবার সময় দুজেনেই কেঁদে ভাসাল। তা যাই হক, প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে দাদু বললেন, ‘‘দাদুভাই, আমি খুব খুশি হলাম, তুমি কি সুন্দর করে সারাদিন ইংরেজিতে কথা বললে।’’ টিঙ্কু অবাক হয়ে বলল, “আমি আবার কখন ইংরাজীতে কথা কইলাম?” দাদু বললেন, “কেন? ক্লোয়ীর সাথে?” টিঙ্কু হেসে বলল, “না না দাদু, হ্যা কইল হ্যার ভাষা, আমি কইলাম আমার ভাষা, আর বাকি সব ইসারায়, উসারায়।” দাদু কি বলবেন বুঝে পেলেন না। পরের দিন সকালে বোনকে বললেন, “চল, আমরা কদিনের জন্য একটু ঘুরে আসি, তুই আর আমি।”

বিকেলে লেটারবক্স খুলে টিঙ্কুই বের করল চিঠি। বড় সাদা খামের বাঁ দিকে দাদার স্কুলের একটা ছবি। তবে কি এটা তার স্কুল ভর্তির চিঠি? ছুটে গিয়ে মা কে বলল, “মা, আমারও স্কুলে যাওনের রিকশা ঠিক কর, চিঠি আইসা গেসে।” মা অবাক। “টিঙ্কু, তুমি বুঝলে কিকরে?” টিঙ্কুর গলায় তখন ভীষণ উত্তেজনা, “তুমি দ্যাখলানা মা, ওপরে স্কুলের সবিখান, হ্যার মানে এ তো আমারই সিঠিই হইব।’’ কল্যানী চুপ করে বসে থাকলেন, এত বুদ্ধি হলেও যদি এমন ভাষা বলে তবে তো ছেলে চান্সই পাবেনা স্কুলে। এদিকে বাড়িতে রব পরে গেল, টিঙ্কু একটা ঘরে বন্ধ। দাদু সমন জারী করলেন, “কারও সাথে দু’দিন দেখা হবেনা, না আম্মা, না দারোয়ানকাকা, না মালিদাদু, কেউ না।” দাদু নিজে দু’দিন বেরলেন না, সারাদিন কেবল “হোয়াট ইস ইওর নেম, হোয়াট ডিড ইউ হ্যাভ ফর ব্রেকফাস্ট’’ করে গেলেন। টিঙ্কুও বেশ ভালই উত্তর দিল। দাদু খুশী। নাতি একটু দুষ্টু বটে, তবে খুব স্মার্ট।

সময়ের খানিক আগেই বাবা, মা আর দাদু সমেত টিঙ্কু পৌঁছে গেছে স্কুলে। ডাক পড়ল, দাদু “অল দ বেস্ট” বললেন, মা বাবার সাথে টিঙ্কু ভেতরে গেল। বিরাট বড় পুরনো আমলের স্কুল, বিশাল ঘর, আর তেমনই মানানসই বড় একটা টেবিলের সামনে ওরা বসল। টেবিলের ওপারে একজন গুরুগম্ভীর প্রিন্সিপাল বসে। তিনিই আগে “গুড মর্নিং” বললেন। টিঙ্কুও প্রত্যুত্তরে “গুড মর্নিং” বলল। মা বাবার বুকের মধ্যে যে দামামা বাজছিল সেটা একটু শান্ত হল বুঝি। এবার প্রিন্সিপাল প্রশ্ন করলেন, “টিঙ্কু, হোয়াট ইস ইওর ফেভারিট থিং?” চটপট জবাব এল, “লাল জুতা আর লাল মুজা। বাবারে কইসিলাম আইন্না দিতে, বাবা কইলেন, এইখানে ভর্তি হইতে পারলেই আইন্না দেবেন।” কল্যানীর মনের অবস্থা তখন বুঝি সীতার মত, “ধরনী দ্বিধা হও, আমি ঢুকে যাই!” শ্যামলবাবু কি করবেন জানেননা, শুধু এতকুটু বুঝলেন যে ছেলের স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে তাঁকে বেজায় বেগ পেতে হবে।

এমনই ভাবনার মাঝে প্রিন্সিপালের অট্টহাস্যে ঘর কেঁপে উঠল। পরিষ্কার বাঙ্গাল ভাষায় কেতাদুরস্ত প্রিন্সিপাল সাহেব বলে উঠলেন, ‘‘এ ভাষা তুমি কোইত্থিকা শিখলা? কিকইরা জানলা?” টিঙ্কুর স্পষ্ট উত্তর, “আমাগো দ্যাশের ভাষা জানুমনা ক্যান? আম্মা কন, নিজেগো ভাষা না শিখলে, অগো ভাষা শিখবা ক্যামনে?” প্রিন্সিপাল খুব হাসলেন, বললেন “হক কথা কইসো! তা তুমি খালি এই ভাষাই জানো, না কি আরও কিছু জানো?” টিঙ্কু সাথে সাথে মালীদাদুর বাঁকুড়ার ‘তা বটেক’ থেকে শুরু করে দারোয়ান কাকার খাস বিহারী ‘সুভা সুভা লোউটা লেইকে গোসল ঘর যাও তনিক’ সব একেবারে শেখানো বুলির মত আউড়ে দিল। শ্যামল আর কল্যানী কি বলবেন, কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কেবল দু’জনে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলেন যেন এইবার তাঁরা ওখান থেকে বেরতে পারেন।

ইন্টারভিউ শেষ। প্রিন্সিপাল উঠে দাঁড়ালেন, বললেন “মিস্টার চ্যাটারজি, ইউ আর ব্লেসেড উইথ আ ব্রিলিয়ান্ট চাইল্ড। আজই অ্যাডমিশন করিয়ে দিন।’’ টেবিলে রাখা বেলটা বাজালেন, কিরিং কিরিং।

কিরিং কিরিং। শব্দটা ক্রমশ জোরাল হতে থাকল। সম্বিত ফিরে পেলেন কল্যানী। সেলফোনটা বেজেই চলেছে, টিঙ্কাই কলিং। তাড়াতাড়ি হ্যালো বলতেই ভেসে এল, “মা, কি করতাস? আরে, বেল বাজাইয়া তো হাতে ব্যাথা হইয়া গেল।বাড়ি নাই নাকি তোমরা?”


No comments:

Post a Comment