ছোটগল্পঃ তুষার সরদার






ছোটগল্প 




সিভিলাইজড্‌
তুষার সরদার




নরেশবাবু একজন প্রায় শাস্ত্রসম্মত এবং যথাসাধ্য ভদ্রলোক। একজন প্রচলিত ভদ্রলোকের প্রায় সব যোগ্যতাই তাঁর মধ্যে বর্তমান। তিনি একটি বৃহৎ ন্যাশান্যালাইজড্‌ ব্যাঙ্কে কাজ করেন। সেজন্য তিনি জীবনের ছোটবড় সব ব্যাপারেই ডেবিট ক্রেডিটের হিসাব করতে অতিশয় অভ্যস্ত এবং দক্ষও বটেন। যথেষ্ট মোটাসোটা বেতন পান এবং সঙ্গতভাবে যেটাতে তিনি কখনই ঠিকমত তৃপ্ত নন। 

নরেশবাবুর মাঝারি দৈর্ঘ্যের চেহারা। উচ্চবিত্ত মেদ-সমৃদ্ধ সুবৃহৎ মধ্যভাগ। নিয়ম করে সিনেমা বা ফ্যাশন পত্রিকার ছবি তিনি দেখেন। একই অর্ন্তবাস তিন চার দিন পরলেও বাইরের পোশাক কিন্তু প্রতিদিন পাল্টে পরেন। টাকা ধার করেন না বা ধার দেন না। বাজারে গিয়ে সবচেয়ে দামি বে-মরসুমী আনাজ এবং মাছ কেনেন। 

তাঁর চশমার ফ্রেম ও লেন্স দুটিই ইমপোর্টেড। মোবাইলটি যথেষ্ট মূল্যবান এবং তাতে গায়ত্রী মন্ত্রপাঠের বা চন্ডীপাঠের বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের বা শ্যামাসঙ্গীতের সুভদ্র রিংটোন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সজোরে বেজে ওঠে। তবে এসব ছাড়া নিজের বিনোদনের জন্য তাঁর মোবাইলে একদম তাজা হিন্দি ফিলমের গান আর বাছাই করা ছোট ছোট পানুর চল-ছবি লোড করা আছে। আর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখনো পর্যন্ত বলাই হয়ে ওঠেনি যে নরেশবাবুর একটি নিজস্ব বাড়ি ও একটি নিজস্ব স্ত্রী আছে। গাড়ি কেনার কথাবার্তা চলছে। শিগ্‌গীরই কেনা হবে। সন্তান একটিই। একমাত্র কন্যাসন্তান ঝিনি এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নরেশবাবুর কন্যা-অন্ত প্রাণ।

নরেশবাবু দৈনিক লোক্যাল ট্রেনে চেপে কলকাতায় কর্মস্থানে যান। মধ্যবর্তী স্টেশন থেকে তিনি ওঠেন। ট্রেনে উঠেই সবদিন বসার জায়গা পান না। সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেদিন ট্রেনে উঠেই তাঁর সন্ধানী দৃষ্টি এদিক ওদিক বোলাতেই একটি সম্ভাব্য বসার জায়গা দেখতে পেয়ে গেলেন। তিনজনের সিটে তিনজন বসে আছে। কিন্তু সবাই জানে এবং মানেও যে লোক্যাল ট্রেনে তিনজনের সিটে চারজন বসে যায়। প্রত্যেকেই মোটাসোটা না হলে এবং ঘেঁষে বসলে তিনজনের সিটে চতুর্থজন মোটামুটি বসতে পারে। সুতরাং অতিশয় শিক্ষিত ভদ্রভাবে নরেশবাবু বললেন, ‘এক্সকিউজ মি, একটু বসাকী সম্ভব হবে?’

তিনজনেই সাধ্যমত সরে বসতে যে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি হল সেটুকু নরেশবাবুর কাছে বেশ কম মনে হল। কেননা তিনি যথেষ্ট লক্ষ্মীমন্ত শরীরের অধিকারী। বসে পড়ার পর যথাযথ স্থানাভাবে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হলেন। তবুও তাঁর আন্তরিক ভদ্রতাবশতঃ তিনি বিনীতভাবে আবার সকলেই বললেন, ‘প্লিজ – আর একটু চাপা যাবে? বড্ড অসুবিধা হচ্ছে।’ তারা আরো ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার চেষ্টা করলো। সেই সুযোগে নরেশবাবুও যথেষ্ট চাপ দিয়ে ঠেললেন। কিন্তু এতে অবস্থার বিশেষ হেরফের হল না। কেন না প্রত্যেকেই বেশ স্বাস্থ্যবান লোক।

কিন্তু নরেশবাবু বুঝতে পারলেন ওই তিনজনই অত্যন্ত নিম্নস্তরের লোক। ওদের মধ্যে সিভিক সেন্স বলে কিছুই নেই। এদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত এরা আর সিভিলাইজড্‌ হতে পারবেই না। হতভাগাদের শিক্ষা, চেহারা, পোশাক, রুচি সবই জঘন্যতম এবং খিস্তিযোগ্য। সেজন্য তিনি ওদের প্রতি অশ্রাব্য খিস্তি দিতে থাকলেন। তবে তাতে কোন দোষের কিছু নেই। একটুও অশোভনও নয় সেসব। কেননা তিনি সব খিস্তিই তো গলার মধ্যে দিচ্ছিলেন। যেহেতু সেইসব কদর্য খিস্তি একেবারেই শোনা যাচ্ছিল না, সুতরাং সেগুলি অশ্রাব্য কী না সেই প্রশ্নটাই তখনকার মত সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে গেছিল।

অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু দৈনিক কেনাকাটা ছিল। সব দিনই কিছু না কিছু এসব থাকে। সেগুলির প্রায় সবই তাঁর একমাত্র আদরের কন্যাটির জন্য। কেনাকাটা সেরে নিয়ে ধীরেসুস্থে তিনি শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এলেন। শিয়ালদহ প্রান্তিক স্টেশন বলে ট্রেনে উঠে একটি জানালার ধারে সুচারু সিটে বেশ ছড়িয়ে বসতে পারলেন। 

ট্রেন ছাড়ার সময় হতে হতেই যথানিয়মে ঘরমুখো যাত্রীর ভিড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ট্রেনটি পরবর্তী স্টেশনে আসতেই একদঙ্গল ভিড় আছড়ে পড়লো কামরার মধ্যে। এরমধ্যে প্রায় সবকটি তিনজনের সিটে চারজন করে বসেছে। নরেশবাবুদের সিটের কাছেও একজন এসে বললো – ‘দাদা, একটু চেপে বসবেন?’

নরেশবাবু ততক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে রাতের সৌন্দর্যের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর সে মগ্নতার মধ্যে এপাশের সহযাত্রীদের মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসার যে চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটাকে আমল দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে চূড়ান্তভাবে বিব্রত ও বিরক্ত করার জন্য একজন সহযাত্রী তাঁর উরুতে ঠেলা দিয়ে বললো, – ‘দাদা, একটু চাপুন না।’

আইনতঃ এটি একটি অফেন্স। তিনজনের জন্য এই সিট নির্ধারিত এবং সেভাবেই টিকিটের দাম ধার্য করা হয়েছে। সেই সিটেই যদি চারজন আইনগ্রাহ্য ভাবে যেতে পারতো তাহলে মাথাপিছু টিকিটের দামও কমে যেত। ডেবিট-ক্রেডিটের হিসাবে দক্ষ নরেশবাবু বুঝলেন এখানে তাঁর হিসাব মত, তাঁর লস অর্থাৎ ডেবিট হয়ে যাচ্ছে। 

কেনই বা তিনি সেটা মানবেন? এই একটি সিটে ভালোভাবে বসে যাবার গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু তাঁর রয়েছে। সে অধিকার পাশের অন্য দু’জন ত্যাগ করার মত নির্বোধ গান্ডুদাস হতে পারে, কিন্তু তিনি নন। তবে তিনি ভদ্রলোক। অন্যকে আঘাত দেওয়াটা তিনি বড়ই অপছন্দ করেন। তাই নড়েচড়ে বসার একটি নিখুঁত অভিনয়মূলক ভঙ্গি করে স্বস্থানেই স্বমহিমায় বসে থাকলেন।

সুস্থির ভাবে বসে যেতে যেতে অধিকাংশ দিনের মত একটি আরামপ্রদ দাঁড়কাক-নিদ্রা সারলেন। তারপর তাঁর গন্তব্য স্টেশনের ঠিক আগের স্টেশনে ট্রেন থামতেই তিনি সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ট্রেন থামা অবস্থায় উঠে দাঁড়ানো বা বাঙ্ক থেকে ব্যাগট্যাগ নামানো খুব সুবিধাজনক। এক হাতে অফিসের ব্যাগ অন্য হাতে মেয়ের জন্য কেনাকাটার ব্যাগ নিয়ে ফুটর্বোডের দিকে চললেন। ধাক্কাধাক্কি করে অসভ্যের মত নামাটা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁর সব কাজের মধ্যেই যথেষ্ট বিবেচনাবোধ থাকে।

ট্রেন থেকে নামবার সময় একেবারে প্রথম সারি বরাবর না থাকাই উচিত। দ্বিতীয় সারিও সুবিধাজনক নয়। নামতে উদ্যত প্রথম সারির সঙ্গে উঠতে উদ্যত যাত্রীদের প্রথমেই একটা ধাক্কাধাক্কি হয়। দ্বিতীয় সারির যাত্রীরা নামলে পথ আরো একটু প্রশস্ত হয়ে যায়। তৃতীয় সারির যাত্রীরা মোটামুটি ভালোভাবে নামতে পারে। চতুর্থ সারি বা পরের যাত্রীরা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হতে শুরু করে, কারণ তখন আবার উঠতে চাওয়া যাত্রীরা দলে অনেক ভারি হয়ে পড়ে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে নরেশবাবু এসব ব্যাপার যথাযথ বোঝেন বলে তিনি নামবার ক্ষেত্রে সর্বদা তৃতীয় সারিতে থাকার চেষ্টা করেন। আজকেও তাই ছিলেন। কিন্তু অন্য একরকম অসুবিধা দেখা দিল একেবারে শেষ মুহূর্তে।

ট্রেনে ওঠার বা নামার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ওঠার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ যাত্রীর একটা বামদিক-প্রবণতা দেখা যায়। নরেশবাবু সেই প্রবণতাকে নিজের অনুকূলে ব্যবহার করার জন্য ফুটর্বোডের বাঁদিকে থাকার চেষ্টা করেন। উঠতে চাওয়া যাত্রীদের সেটা ডানদিক হয় বলে চাপটা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হয়।

ট্রেন থামামাত্র ওঠা-নামার হুড়োহুড়িটা শুরু হয়ে গেল রোজকার মতন। অভিজ্ঞ নরেশবাবুর দু’হাতে ব্যাগ থাকলেও তাঁর নিজের হিসাবমত নিরাপদে নামবার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রেনে উঠতে উদগ্রীব বাঁদিকের ভিড়টার দিকে তাঁর চোখ অভ্যাসমত চলে গেল। তিনি দেখতে পেলেন ভিড়ের ধার ঘেঁষে বছর ষোল-সতেরোর বাড়ন্ত স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর কন্যা ঝিনির চেয়ে দু’তিন বছরের ছোটই হবে। গ্রাম্য সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তিনি ফুটবোর্ডে থমকে গেলেন দু’সেকেন্ডের জন্য। 

চকিতে বাঁ’হাতের ঝোলানো ব্যাগটা ডানহাতে চালান করলেন। তাঁর পিছনের লোকেরা ‘কী হল কী দাদা?’ বলতে বলতে তাঁর পাশ কাটিয়ে, কেউ বা ধাক্কা দিয়ে নেমে গেল। প্রায় সবাই নেমে পড়েছে। এইবার তিনি নামবেন। স্বাভাবিক নিয়মমত ওঠার ভিড়টা এখন এগিয়ে আসছে। ঠিক এই সময়ে উঠতে আগ্রহী যাত্রীরা খুব স্বাভাবিক ভাবে অসতর্ক থাকে। নিখুঁত হিসেব করে প্ল্যাটফর্মে এক পা দিতে দিতে নরেশবাবু এবার তাঁর অভিজ্ঞ বাম কনুইটি তুলে দক্ষতার সঙ্গে সজোরে নিক্ষেপ করলেন ভিড়ে চলাফেরায় অনভিজ্ঞ মেয়েটির বুক লক্ষ্য করে।

এসব কখনও ব্যর্থ হয় না, ব্যর্থ হবার কথাও নয়। কিন্তু তাঁর কনুই লক্ষ্যভেদ করার ঠিক আগেই দুর্ভাগ্যক্রমে সেই মেয়েটির হাত থেকে কিছু একটা পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ সে নীচু হয়ে সেটা তুলতে গেল। নরেশবাবুর কনুই হাওয়ায় ধাক্কা দিয়ে অন্য একজনের হাত সামান্য স্পর্শ করে ফিরে এল। ভিড়ের চাপে বেসামাল ভাবে সামনের দিকে সরতে সরতেই পেছন দিকে খানিকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে দেখে বুঝলেন যে আর কোন আশা নেই। সেই মেয়েটি ততক্ষণে আবার সোজা হয়ে ট্রেনের ফুটবোর্ডে পা রেখেছে। 

বেশ কিছু ছেলে-ছোকরা-বুড়ো সেই সঙ্গে ঠেলেঠুলে অসভ্যের মত তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করছে। যে কোন অবস্থাতেই, বিশেষ করে ভিড়ের সময়ে মহিলাদের যে আগে উঠতে দেওয়া সবসময় উচিত, সেটা কী এরা জানেই না! তিনি এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। প্রচন্ড রাগে-বিরক্তিতে তিনি ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, - 

‘হে-এ-এ-ই ! তোমরা মানুষ না অন্যকিছু? তোমাদের কী সিভিক সেন্স বলে কিছু নেই? আগে লেডিস-কে উঠতে দাও না....!!’

No comments:

Post a Comment