ছোটগল্পঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



ছোটগল্প



কাঁথাকাহিনী, দ্বিতীয় পর্ব
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়



সুহাসিনী মরিবার কালে তাঁহার ‘বেগমবাহার’ ও ‘তোতাবাজার’ নামক দুইখানি কাঁথা ও একখানি শতচ্ছিন্ন চেলী রাখিয়া গিয়াছিলেন। সকলেই বুঝিয়াছিল এই উপহার ঘোষেদের কন্যা ননীবালার জন্য। কিন্তু ‘নতুন বাবু’ কে সুহাসিনী কাহারও জন্য রাখিয়া যান নাই, উহা বক্ষে জড়াইয়া মরিয়াছিলেন। এমন সুন্দর কাঁথাখানি সুহাসিনীর মৃতদেহের সহিত দাহ হইবে, তাহা গ্রামস্থ অনেকেই মানিয়া লইতে পারিতেছিলেন না, বিশেষতঃ কন্যা দায়গ্রস্ত পিতাগণ। কে বলিবে, হয়তো আবার কখনও কোন কন্যার বিবাহে কাঁথাখানির প্রয়োজন হইতে পারে! কিন্তু তাই বলিয়া মড়ার গায়ের কাঁথা রাখিয়া দিতেও মন মানিতেছে না। তাহাতে গৃহস্থের অকল্যাণ হইতে পারে। সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া স্থির হইল, ওই কাঁথাখানি সুহাসিনীর গৃহেই রাখা থাকুক, পরে তাহা লইয়া আলোচনা করিলেই চলিবে। সুহাসিনীর গৃহে একখানি ভাঙ্গা তোরঙ্গের উপর কাঁথাখানি আলগোছে কেহ ছুঁড়িয়া দিল। তোরঙ্গে নানা মাপের কয়েকটি সূচ ও নানা রঙের কয়েকটি সূতা ব্যতীত আর কিছুই নাই। সুহাসিনীর ভগ্নপ্রায় গৃহে শিকল পড়িল। 

সুহাসিনীর মৃত্যুর ঠিক একমাস পর ননীবালার বিবাহ স্থির হইয়াছিল। পাত্রপক্ষ দেরি করিতে চাহে না। এমন গুণবতী কন্যাটিকে ঘরে না লইয়া গেলেই নয়। সুহাসিনীর মৃত্যুর পর কাঁথা দুইখানি হাতে পাওয়ায় ননীবালার পিতা এবং মাতাউভয়ের কিঞ্চিৎ সম্মান রক্ষা হইতে পারে, ননীবালার হস্তশিল্প বলিয়া চালান করা এখন সহজ হইয়াছে, দাবী করিবার কেহ নাই। স্থির হইল উহা ননীবালার সহিত বিবাহের যৌতুকবলিয়া শ্বশুরালয়ে পাঠানো হইবে। 

এই পর্য্ন্ত সবই ঠিক ছিল। ঘোষেরা অবস্থাপন্ন লোক, তাহাদের সহিত অনর্থক কেহ বিবাদে লিপ্ত হইতে চাহে না। হইলেও ব্রজমোহনের সহিত পারা কঠিন। সুহাসিনীর স্বামী অমূল্যচরণ বাঁচিয়া থাকিতে তাহার সহিত ব্রজমোহনের পিতা রাধামোহনের গালিগালাজের সাক্ষী এখনো দুই-চারিজন গ্রামে বর্তমান । তাহাদের বাল্য-কৈশোর-যৌবনে কেহ কেহ ইহা শুনিয়াছেন। সেই কারণেই ব্রজমোহনকেও পাশ কাটাইয়া চলা সমীচীন মনে করেন। কিন্তু গত কয়েক বৎসর হইল গ্রামে আর একটি পরিবার ব্রজমোহনের সমান হইয়া উঠিয়াছে। অর্থে, প্রতিপত্তিতে এবং গালিগালাজ নামক গুণ অথবা অ-গুণটিরও সমকক্ষ হইয়া উঠিয়াছে। সুহাসিনীর মৃত্যুতে তাঁহারাও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গরীব বিধবার মৃত্যুকে কেন্দ্র করিয়া দুইপক্ষের কাজিয়া জমিয়া উঠিল। বিধবার শ্রাদ্ধ করিতে উভয়পক্ষই তৎপর। গোল বাধিল এই লইয়াই। ব্রজমোহন কন্যার বিবাহ অপেক্ষা সুহাসিনীর কাঁথা দুইটিকে পাত্রপক্ষের কাছে যৌতুক পাঠাইয়া সম্মান রক্ষা করিতে বেশি তৎপর। অপরপক্ষ সুহাসিনীর কাঁথা দুইটি কাড়িয়া লইয়া অর্থ ও পেশী শক্তির বলে গ্রামের প্রধান রূপে বিবেচিত হইতে বেশি তৎপর। কোনপক্ষেই মীমাংসা হইল না। গোলযোগ বাড়িতে লাগিল। অপরদিকে বিবাহের দিনও সম্মুখে আসিতে লাগিল। কিন্তু ননীবালা, তাহার কি হইল? সে কি করিবে? 



(২)

সুহাসিনীর সহিত ননীবালার সদ্ভাব ছিল। বাল্যকালে সে সুহাসিনীর প্রিয় পাত্রী ছিল। পিতার সহিত সুহাসিনীর সম্পর্ক যেমনই হউক, সুহাসিনী ননীবালাকে স্নেহ করিতেন। বয়স একটু বাড়িলে ননীবালা বুঝিয়াছিল, সুহাসিনীর তিন কূলে কেহ নাই। সুহাসিনী নানা রঙের সুতা দিয়া ‘নতুনবাবুকে’ সেলাই করিতে করিতে ননীবালার সহিত গল্প করিতেন। ‘নতুনবাবুর’ প্রতি তাঁহার দুর্বলতা ছিল বিশেষ রকমের। সুহাসিনী তাঁহার ভাঙা তোরঙ্গের দায়িত্বভার বালিকাকে অর্পণ করিয়াছিলেন। ক্রমে তাঁহাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হইয়াছিল। সেই বন্ধুত্ব সমান কি অসমান তাহা আমরা বলিতে পারি না। তবে ননীবালাও গৃহ হইতে এটা-সেটা, আমতেল-আচার ইত্যাদি শাড়ির আঁচলে লুকাইয়া বৃদ্ধার কাছে আনিয়া দিত। গরীব বিধবা সুহাসিনী তাহাতে পরম সন্তোষ লাভ করিতেন।

বিবাহের কয়েকদিন মাত্র পূর্বে এক সকালে সকলের অলক্ষ্যে ননীবালা সুহাসিনীর গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। সুহাসিনীর ঘরে আসবাব পত্র কিছুই প্রায় ছিল না। একটা চৌকি, দুইটা টিনের পা-বাঁকা চেয়ার, একটি তোবড়ানো বালতি, একটি এল্যুমিনিয়ামের ঘটি এবং একটি ভাঙ্গা তোরঙ্গ ছাড়া তাহার আর প্রায় বিশেষ কিছুই ছিল না। এই অল্পমাত্র আসবাব পত্র দিয়া কি করিয়া সুহাসিনী সংসার চালাইতেন ভাবিয়া ননীবালা বিস্মিত হইল। সে বড়ঘরের কন্যা। তাহার বাপের বিস্তর জমিজমা, গৃহে পিতল-কাঁসাও মজুদ আছে। সুহাসিনী কিসে খাইতেন আর কিসে রান্না করিতেন সে বিস্তর চিন্তা করিয়াও কোন সমাধান খুঁজিয়া পাইল না। তবে কি তিনি না খাইয়া থাকিতেন? ননীবালার বাল্যকালের সুদিনের কথা এবং সুহাসিনীর স্নেহের কথা মনে করিয়া আনন্দিত এবং বেদনা উভয়প্রকার বোধ অনুভূত হইল। 

ফাঁকা ঘরে চৌকির উপর সে কিয়ৎক্ষণ বসিয়া রহিল। চারিদিকে ধূলা, খাটের উপর তোরঙ্গটা কে যেন তুলিয়া রাখিয়াছে। তবে কি কেহ এইঘরে আসিয়াছিল? তবে কি কেহ সুহাসিনীর জিনিসপত্র চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে? ননীবালা চারিদিকে চাহিয়া কি মনে করিয়া তোরঙ্গের উপরে হাত দিল। পরম মমতায় তাহার গায়ে হাত বুলাইতে লাগিল। দেখিল তাহাতে তালা নাই। তালা কি কখনও ছিল, নাকি ছিল না... ননীবালা মনে করিতে পারিল না। তোরঙ্গটি খুলিবে কি খুলিবে ভাবিতে লাগিল। একদিকে কি যেন এক কৌতুহল, অন্যদিকে অসমবয়সী সেই বৃদ্ধার স্নেহের কথা মনে করিয়া সে ধীরে ধীরে তোরঙ্গটি খুলিয়া ফেলিল। দেখিল ‘নতুনবাবু’ তাহার মধ্যে জড়োসড়ো হইয়া আছে। ননীবালা বিস্মিত হইল। মাতার নিকট শুনিয়াছিল, মড়ার গায়ের কাঁথা বলিয়া ইহাকে কেহ স্পর্শ করিতে চাহে নাই, আলগোছে তোরঙ্গের উপরে তাহা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছে। তবে কে তাহাকে তোরঙ্গের ভিতরে রাখিল? কেহ কি এই ঘরে আসা-যাওয়া করে? নাকি সেদিনই কোন ব্যক্তি কাঁথাখানি দয়াবশতঃ তোরঙ্গের ভিতরেই রাখিয়া দিয়াছিলেন? এইবারে ননীবালা কিছুটা ভীত হইল। যদি কেহ দেখিয়া ফেলে, যদি সেই ব্যক্তি এইখানে আসিয়া তাহাকে জেরা করে? কিন্তু কি এক আকর্ষণে ‘নতুনবাবু’কে একবার স্পর্শ করিতে গেল। একস্থানে স্পর্শ করিয়া কেমন যেন ঠেকিল। মনে হইল কাঁথার ভিতরে বুঝি বা কিছু রাখা আছে। আরো একবার তাহা স্পর্শ করিল। একইরকম মনে হইল। আরো একস্থানে হাত দিল। দেখিল সেই স্থানেও যেন ভিতরে কিছু রাখা আছে। চুরির অপবাদের ভয়, ঘরে অন্য কোণ ব্যক্তির ভয়, গ্রামের লোকের ভয় সব কিছুই সে এক্ষণে বিস্মিত হইল। সজোরে ‘নতুনবাবুকে’ ঝাড়িতে লাগিল। হলুদ আর কালো রঙের খোপগুলিতে কাগজের মত কি যেন আছে মনে হইল। ননীবালা এইবারে কাঁথাটিকে পড়পড় করিয়া ছিঁড়িতে লাগিল। তাহাকে যেন ভুতে পাইয়াছে। সুহাসিনীর এতদিনের শখের কাঁথাখানিকে সে ফাড়িয়া ফেলিল। কাগজের নোট তাহাতে ভরা আছে। জোরে দুই-একবার আরো ঝাড়িতে ঝাড়িতে তাহা ভূমির উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। ননীবালা বুঝিল, সুহাসিনী কাঁথাগুলি গ্রামের সম্পন্ন গৃহে বিবাহের সময় ভাড়া দিয়া যে টাকা পাইত, এতদিন ধরিয়া সমস্ত টাকা এই ‘নতুনবাবুর’-কে ভিতরে রাখিয়া গিয়াছেন। সারাদিনের কাজের অবসরে সুহাসিনীর ‘নতুনবাবু’ লইয়া নানান রঙের সূতা দিয়া সেলাই করিবার ভঙ্গিমাটি যেন ছবিটির মত তাহার মনে ভাসিতে লাগিল। ননীবালা তোরঙ্গের উপরে মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল। 

বিবাহের একদিন পুর্বে ব্রাহ্মণ দ্বারা সুহাসিনীর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হইল। গ্রামের কাহারও নিকট একটি পয়সাও ননীবালা গ্রহণ করে নাই। 

বিবাহের দিন সে ‘বেগমবাহার’-এর উপর রাজেন্দ্রাণীর মত বসিয়াছিল।

3 comments:

  1. প্রথম পর্বের মতই দ্বিতীয় পর্বটিও সুখপাঠ্য।

    ReplyDelete
  2. বড় আবিল, বড় মেদুর লেখা... বিভূতিভূষণের কথা মনে করিয়ে দেয়...

    ReplyDelete
  3. Indir thakuron jeno.aha boro sundor.

    ReplyDelete