ছোটগল্প : নারায়ণ রায়





ছোটগল্প



কেয়াফুলের গন্ধ
নারায়ণ রায়



মানুষের কত রকমের নাম হয়, ছোট বেলায় আমাদের সেই দামোদর পাড়ের ছোট্ট গ্রামে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের নাম ছিল নগরবাসী সমাদ্দার। পরে বড় হয়ে আমি ভাবতাম অমন একটা অজ গ্রামের একজন ব্যক্তির নাম নগরবাসী হ’ল কি করে? আমি প্রিয়দশর্ন সরকার নামে এক ভদ্রলোককে চিনতাম যিনি মোটেও সুদশর্ন ছিলেন না। আবার অপরাজিতা নামের একটি মেয়েকে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় বার বার পরাজিত হতে দেখেছি। কিম্বা আমাদের পাড়ার মাধুরী বৌদির শরীরে বা মনে মাধুর্য্যর ছিটে ফোঁটাও ছিল না। অবশ্য কথায় বলে নামে কিই বা এসে যায় ? আজ সকালে অলস মস্তিস্কে এইসব হ য ব র ল চিন্তা করতে করতে একটা কথা আমার মাথায় এল, সেটা হ’ল একটা বিরাট সংখ্যক ছেলে মেয়েদের নাম ফুলের নাম দিয়ে। আমি সেই নামগুলো একটা একটা করে মনে করে একটা কাগজে লিখলাম। আমি মোট ৩০/৩২ টা ফুলের নাম মনে করতে পারলাম। দেখলাম ৩০/৩২টার মধ্যে ২২/২৩ টাই মেয়েদের দখলে আর মাত্র ৮/৯টার মত ছেলেদের দখলে। অর্থাৎ প্রথমেই ছেলেরা মেয়েদের কাছে ১৪ (২৩-৯) গোলে হেরে গেল। মেয়েদের দখলে তেমন কিছু ফুলের নাম আমি এখানে দিলাম যেমন :- অপরাজিতা, করবী, চাঁপা, মালতী, কামিনী, কৃষ্ণচুড়া, কেয়া, জবা, টগর, গোলাপ, দোলনচাঁপা, নয়নতারা, পদ্ম, বকুল, বেলী(বেলা), মাধুরী, যুঁই, যুথিকা, লিলি, শিউলি (শেফালী), হাসনুহানা । আর ছেলেদের দখলে তেমন ফুলগুলো হ’ল :- কাঞ্চন, নাগেশ্বর, নীলমণি, পলাশ, পারিজাত, বকুল, রঙন, শিরীষ।

ছোটবেলায় আমার অনেক বন্ধুর মধ্যে একজন বন্ধুর নাম ছিল কেতকী। আমি যখনকার কথা বলছি সেটা ছিল চোর-পুলিশ, কুমির-ডাঙ্গা খেলার বয়স। আমরা গ্রামের একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। অজ গ্রামের পন্ডিত মশাই-এর পাঠশালার মত একটা খড়ের চার চালা প্রাইমারী স্কুল, স্কুলে যাবার পথে হেড স্যারের বাড়ি থেকে চাবি নিয়ে গিয়ে স্কুলের দরজা জানলা খোলা, ঝাট দেয়া, প্রত্যেক ক্লাশের কলসীতে খাবার জল ভরে রাখতে হ’ত। এছাড়া প্রত্যেক মাষ্টার মশাই-এর টেবিলে একটা করে হাত পাখা আর হাজিরা খাতা গুছিয়ে রাখতে হ’ত। তবে আমরা ইচ্ছে করেই কঞ্চির ছড়ি গুলোকে দরজার আড়ালে ঘরের কোনে লুকিয়ে রাখতাম। কাজগুলো ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই পালা করে করতে হ’ত। আর কেন জানিনা এই কাজটা করার ব্যাপারে আমাদের দুজনের দারুণ উৎসাহ ছিল। গ্রামের স্কুলে ১১টার আগে কেউ আসতো না, কিন্তু আমি আর কেতকী ১০টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছে যেতাম। তারপর আমরা দুজনে পুরো স্কুলটা ঝাঁট দিতাম, টিউব ওয়েলে আমি পাম্প করতাম আর কেতকী একটা একটা করে কলসীতে জল ভরতো আর সেগুলো আমি একে একে ক্লাসে ক্লাসে রেখে দিয়ে আসতাম। তখন আমাদের দুজনের আট-দশ বছর বয়স, তখনও প্রেম বা যৌনতা কাকে বলে, সেটা বোঝার বয়স হয়নি। তবু আজও আমার মনে আছে - ও কাছে থাকলে আমার খুব ভালো লাগতো, আমি ওর শরীরের একটা অদ্ভুত গন্ধ পেতাম। এত বছর পরে আজও চোখ বুজলে সেই গন্ধটা পাই। ছোট্ট গ্রাম, আর আমাদের দুজনের বাড়িও ছিল কাছাকাছি, তাই স্কুলের বাইরেও আমাদের প্রায়শই দেখা হ’ত। বিকেলে আমরা সবাই আমাদের বাড়ির পাশে একটা সান বাঁধানো পুকুর পাড়ে পাকুর গাছের তলায় কুমির-ডাঙ্গা কিম্বা চোর-পুলিশ খেলতাম। খেলার নিয়মে স্বাভাবিক ভাবেই কেতকীও মাঝে মাঝে চোর কিম্বা কুমির হ’ত। কিন্তু পরবর্তী কালে একটা বয়সে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস মনে পড়েছে যে ও যেদিন চোর হ’ত সেদিন কোন মতেই আমি ওকে ধরতে পারতাম না। অন্য কেউ না কেউ ওকে ধরত, কিন্তু আমি ওকে কোনদিন ধরতে পারিনি। আবার একই ভাবে কেতকী যেদিন কুমির হ’ত সেদিন কেতকীও কোনমতে আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। অর্থাৎ, দলের মধ্যে আমরা দুজন পরস্পরের সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্বেও আমরা একজন আর একজনকে কোনদিন স্পর্শ করতে পারতম না। কিন্তু ওকে স্পর্শ না করলেও কেতকী কাছে এলেই ওর গায়ের ঐ মিষ্টি গন্ধটি আমি ঠিক পেতাম।

ঠিক এই সময়ে আমি বেশ কিছুদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার স্কুল যাওয়া, খেলা ধূলো সব বন্ধ। কবিরাজ মশাই বললেন ‘টাইফয়েড’, খুব সাবধানে থাকতে হবে। লাল রঙের গোলা ওষুধ আর কাগজে মোরানো পুরিয়া ওষুধ দিলেন। মুখে রুচি নেই, তার উপর ঐ বিশ্রি ওষুধ গুলো খেতে একদম ভালো লাগতো না। আমার বাবা মা আদর করে কিছু বলতে এলেও আমি তাদের উপর রেগে গিয়ে উল্টো-পাল্টা বকে দিতাম। একমাত্র কেতকী আমার কাছে এলেই আমার মনটা খুসিতে ভরে উঠতো। ও আমার বিছানার পাশে এসে বসলেই আমি ওর গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা পেতাম আর আমার সব রোগ এক নিমেষে সেরে যেত। তখন কেতকী বলত, “কাল আমি তোর জন্য খামারডাঙার মাঠে গিয়ে বনকুল এনে দেব, তোকে লুকিয়ে কদবেলের আচার এনে দেব, খেয়ে দেখিস একদিনেই তোর জ্বর সেরে যাবে।”

এর পর আমি আস্তে আস্তে সেরে উঠলাম। আবার আমাদের দুজনের স্কুলে সেই ঝাঁট দেওয়া জল ভরা শুরু হ’ল। আবার সেই কুমির-ডাঙ্গা, চোর-পুলিশ। তারপর একদিন আমরা পাঠশালার পাঠ শেষ করে আমি ছেলেদের হাই স্কুলে ভর্তি হলাম আর কেতকী মেয়েদের হাই স্কুলে ভর্তি হ’ল।

আস্তে আস্তে আমার মনে হ’ল কেতকী কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। আগের মত আর তেমন আমাদের সঙ্গে কুমির-ডাঙ্গা কিম্বা চোর-পুলিশ খেলতে আসেনা। আমার সঙ্গে দেখা হ’লে আগের মত বক বক করে না, শুধু হালকা দু-একটা কথা হয়। তবে যখনই আমার পাশ দিয়ে ও হেঁটে যেত একটা জিনিস লক্ষ করতাম, ওর গায়ের সেই গন্ধটা যেন আরও তীব্র আরও সুমধুর হয়েছে।

সেদিন কি একটা কারণে আমাদের দুজনেরই স্কুলের ছুটি। আমরা দুজনে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। গরম কাল তখন বেলা পাঁচটা হবে। কেতকীকে দেখলাম দুটি বেনী দুলিয়ে খালপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কেতকী বলল, “চল, খামার ডাঙার মাঠে যাবি ?” আমি তো যাকে বলে এক পায়ে খাঁড়া, মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই এক যায়গায় এসে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, বাঁ দিকে আমাদের বাড়ি, আর ডান দিকে কেতকীদের বাড়ি। আমরা ডানদিক বাঁদিক না গিয়ে সোজা জঙলের দিকের পায়ে হাঁটা রাস্তা বরাবর এগোতে লাগলাম। রাস্তা বরাবর ডানদিকে ভুবনডাঙ্গার খাল। আমি বললাম, “একদিন তোকে নিয়ে তালগাছের ডিঙ্গিতে চড়ে ঐ খাল দিয়ে অনেক দূরে শামুকপোতার বিলে গিয়ে নীল পদ্ম তুলে আনবো।” কেতকী বলল, “সেই ভালো, একটা তাল গাছের ডিঙ্গিতে দুজনের বেশী চাপলে তো ডুবেই যাবে, তাই শুধু তুই আর আমি চাপবো।”

এইসব কথা বলতে বলতে একটা যায়গায় পৌছে দেখলাম কেতকীর গায়ের গন্ধটা আরও সুতীব্র আরও সুমধুর লাগছে। এই প্রথম আমি কেতকীকে বললাম, “জানিস, আমি যখনই তোর পাশে আসি একটা সুন্দর গন্ধ পাই। এখন সেই গন্ধটা আরও সুতীব্র আরও সুমধুর লাগছে।” কেতকী বলল, “দুর, বোকা ডান দিকে তাকিয়ে দেখ।” আমি ডান দিকে তাকিয়ে দেখে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললাম, “আরে এটা কেয়া ফুলের গাছ না?" আমি এর আগে কখনও কেয়া গাছ দেখিনি। তবে বইতে ছবি দেখেছি, বাবা মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, কয়েকটা আখ গাছ যেন জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা লম্বা তলোয়ারের মত পাতা আর পাতার দুদিকে ধারালো কাঁটা। আর গাছটার মাথার কাছে সাদা মোচার খোলার মত খোলার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুল।

আমি বললাম, “দাঁড়া আমি ঐ কেয়া ফুলটা তুলে আনি,” কেতকী বলল, “এই না না, যাস না, ঐ গাছের গোড়ায় সাপ থাকে, তাছাড়া ঐ কাঁটায় তোর হাত পা ছড়ে যাবে। তুই যাস না প্লিজ।” আমি তবু নাছোড়বান্দা, আমি বললাম, “না না আমি কোন কথা শুনবো না, আমি যাবই, আমি জানতে চাই তোর গায়ের গন্ধ ঐ গাছটা পেল কোথা থেকে?” একথা বলে আমি ডান পা টা ঐ কেয়া গাছটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে কাঁটাপাতা গুলো সরাতে যাবো ঠিক তখনই কেয়া আমার বাম হাতটা ধরে এক টান মারতেই আমরা দুজনেই টাল সামলাতে পারলাম না। উল্টোদিকের নরম ঘাসের উপর চিৎ হয়ে ছিটকে পড়ল কেয়া, আর আমি গিয়ে পড়লাম কেয়ার উপর, তখন কেয়া তার দুহাত দিয়ে আমার পিঠে কিল মারতে মারতে বলল, “ওরে, হাঁদা গঙ্গারাম, তোর কেতকীর ই আর এক নাম যে কেয়া সেটা জানিস না? কেয়া আর কেতকী কি আলাদা ?

No comments:

Post a Comment