সম্পাদকীয়








অতিথি সম্পাদকের কলমে
দেবাশিস কাঞ্জিলাল



ঋতবাকের সম্পাদিকা তাঁর এই পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় আমাকে একটি সম্পাদকীয় লিখে দেবার দাবী জানিয়েছেন। 

আমি প্রধানত একজন পাঠক, সামান্য যা একটু লেখালিখি করার সকুন্ঠ প্রয়াস করি তাতে অতিথি-সম্পাদকের গুরু-দায়িত্ব বহনের যোগ্যতা আমার আছে কি না তা নিয়ে আমি নিজেই যথেষ্ট সন্দিহান। 

তবু স্নেহের দাবী এড়ানো কঠিণ বড়ো! তাই কিছু মনের কথাই এখানে বলে যাই, জানি না এখানে ধান ভানার বদলে শিবের গীত গেয়ে গেলাম কিনা ।

আজকাল সে ছাপা-পত্রিকা হোক বা অন্তর্জাল-পত্রিকাই হোক, সেখানে বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকার বেশ অভাব দেখি। অধিকাংশই সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা ধরণের পত্রিকা, সেখানে রান্না-বান্না, সাজন-গোজন, অসুখের দাওয়াই-বর্ণনা, সিনেমা-থিয়েটারের নটনটীদের প্রচ্ছন্ন বিজ্ঞাপন সহ আরো কত-শত-কিছু সাহিত্যকে সরিয়ে সুয়োরানী হয়ে বসে থাকে । 

যাঁরা পত্রিকা-ব্যবসায়ী তাঁদের এই প্রয়াসের ব্যখ্যা পাওয়া যায়, তাঁরা সব ধরনের লোকের কাছে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তাঁদের লাভের কড়ি বাড়িয়ে নিতে চান । কিন্তু অন্তর্জাল-পত্রিকা তো এখনও সেই অর্থে ব্যবসায়িক হয়ে ওঠে নি । তবে তার সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা হবার কারণ কি ?

আমার ধারণা, অন্তর্জাল-পত্রিকা এখনো তেমন ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে নি নানান কারণে। প্রথমত, লোকে এখনও ছাপা লেখা পড়তে বেশি স্বচ্ছন্দ । আসলে ছাপা লেখার সাথে যে আত্মীয়তা আমাদের বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছে তা পরিবর্তন করা দুরূহ এখনো বেশ। ফলে নেট-পত্রিকার পাঠক সংখ্যা তুলনায় বেশ কম এখনো। 

দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই পত্রিকার পাঠক তুলনায় কম, তাই এখানে প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা লেখা দিতে ততটা আগ্রহী নন । তবু কিছু ভালো লেখকেরা যাঁরা এখনো ততটা নামী হয়ে ওঠেন নি, প্রধানত তাঁরাই লেখা দিয়ে সম্বৃদ্ধ করেন বিভিন্ন নেট-পত্রিকাকে ।

তৃতীয়ত, সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা করতে পারলে তা বেশী লোকে খাবে, সেই আশা নিয়েও বহু নেট-পত্রিকা বাঁচার চেষ্টা করে। 

কিন্তু সেক্ষেত্রে এই নেট-পত্রিকা নিজেকে বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা দাবী করার অধিকার হারায়। সৌভাগ্যের বিষয় অল্প হলেও কিছু পত্রিকা বেশ কিছুদিন ধরে নিজেদের সাহিত্য-পত্রিকা বলে দাবী করার যোগ্যতা বজায় রেখে চলেছে । অন্তর্জাল-সাহিত্য-পাঠকেরা তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকিবহাল। তাই তাদের নামোল্লেখ থেকে এখানে বিরত রইলাম। যদি কোন পাঠক তাদের নাম জানতে চান, তবে আমাকে জানালে সেই সব পত্রিকার নাম পাঠানো যাবে । 

সদ্যোজাত এই ঋতবাক পত্রিকাটির জন্মলগ্নে আমি যতদূর জানি, সম্পাদিকা তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের সাথে আলোচনা-সাপেক্ষে স্থির করেছিলেন, এই পত্রিকা একটি সম্পূর্ণ সাহিত্য-পত্রিকাই থাকবে, সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা হবে না । আশা করি, তিনি তাঁর সেই শুভ প্রয়াস আপোষহীন ভাবেই জারী রাখবেন এবং লেখার সংখ্যার চেয়ে মানের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখবেন । 

সেই উৎকর্ষতা বজায় রাখতে যদি একটিমাত্র লেখা দিয়েও কোন সংখ্যা প্রকাশ করতে হয়, তিনি তাই করবেন, যা পত্রিকাটিকে একটি বিশেষ পাঠক-বৃত্তের কাছে অনেক বেশি গ্রহণীয় করে তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস।

আরেকটি ছন্নচিন্তা মাথায় এলো শরৎচন্দ্রের একটি লেখার কথা মনে পড়ে । চিরকাল সাহিত্যে সমাজের যে প্রতিফলন ঘটে তা কিন্তু শুধুমাত্র সমাজের সব আঙ্গিনার ভালোমন্দ দুঃখ-সুখের ফটো মাত্র নয়, তা লেখকের মননে জারিত করে সামাজিক উত্তরণের পথনির্দেশের আঁকা ছবি। 

আজকাল এমন আঁকা ছবি সংখ্যায় ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ। শুধু নর্দমার ফটো যথাযথ বাড়ছে । তা স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আর্থিক উপঢৌকনের বিনিময়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা-মননকে নষ্ট করে, মেরুদন্ডহীন করে দিয়ে যে সামাজিক অবক্ষয়ে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। 

এই অশুভ প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে লেখকেরা আরো বেশি করে সমাজমুখী লেখা লিখলেই তা সম্ভব, যে লেখা মানুষকে স্বার্থপরতা থেকে বিমুখ করে পরার্থপর হতে শেখাবে । প্রতিটি মানুষকে একটি মহাদেশের অংশ হতে শেখাবে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হতে নয় ! 

আর এইখানেই ঋতবাক অনেক কিছু করতে পারে। তার লেখক ও পাঠককুলকে নিয়ে নিয়মিত আলোচনা-সভা, মত-বিনিময়, বিষয়-কেন্দ্রীক আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তাই ঋতবাক শুধুমাত্র একটি পত্রিকা না থেকে নিজেকে একটি সাহিত্য-আন্দোলনে পরিণত করুক, এই কামনা নিয়েই আমার এই লেখনীকে স্তব্ধ হতে বললাম।

- অলমিতি 

প্রচ্ছদ নিবন্ধ: শ্রীশুভ্র



প্রচ্ছদ নিবন্ধ



‘বহিরাগত’ তত্ত্ব: নেপথ্যের সমীকরণ
শ্রীশুভ্র



[“The strength of the government lies in the people’s ignorance , and the government knows this, and will therefore always oppose true enlightenment.” --LEV TOLSTOY.]

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি ও উত্তাল ছাত্র আন্দোলের রাশ টানতে রাষ্ট্রশক্তি যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব! অবরূদ্ধ উপাচার্যকে ঘেরাও মুক্ত করতে নিরীহ নিরস্ত ছাত্রছাত্রীদের উপর পুলিশি তান্ডবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। আর সেই প্রেক্ষিতেই সমগ্র পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণাধীন রাখতে প্রশাসন থেকে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব আমদানী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে বসাতে হয়েছে পুলিশি পিকেট। বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অধিকার। আর সেইখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক! যার অভিমুখ মূলত দুইটি, একটি হল কে বহিরাগত আর কে বতিরাগত নয়! অপরটি হল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনকে সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করা কতটা পরিমাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার অনুসারী! 

সুখের কথা এই বিতর্কে ছাত্রছাত্রীরা যেভাবে পাশে পেয়েছে তাদের অধ্যাপক অধ্যাপিকা থেকে শুরু করে প্রাক্তন শিক্ষাবিদদের অধিকাংশের, তার একটা সুস্পষ্ট ইতিবাচক প্রতিফলন পড়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের থেকে শুরু করে সাধারণ জনমানসেও। এই প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস সুপ্রিয়া চৌধুরী, কোনও অবস্থাতেই ‘বহিরাগত’ শব্দটির ব্যবহার সমর্থনযোগ্য নয় জানিয়ে বলেছেন, আসলে বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি স্থান, যেখানে সমাজের নানা পরিচয়ের মানুষকে স্বাগত জানানো আমাদের কর্তব্য। সকলের মত বিনিময় হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের মধ্যে। তাই পুলিশের পিকেট বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ছাত্র শিক্ষকদের প্রবেশ আটকানো কোনভাবে কাম্য নয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দিকে পাঁচিল তোলা যে আদতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণারই পরিপন্থী সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অমিতা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “সারা বিশ্বে কেনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা পাইনি। তা ছাড়া আমাদের পুরানো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো জনসাধারণের অর্থানুকূল্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ তো সাধারণের সম্পদ। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কখনও বেঁচে থাকতে পারে কি?” এই বিষয়ে যাদবপুরেরই প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রোটেক্টটেড এরিয়া হতে পারে না! তাঁর কথায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই পড়তে আসে। শিখতে আসে। বিভিন্ন বিভাগে সেমিনার হয়, শুনতে আসে। বর্তমানে ছাত্র-গবেষক যেমন উপস্থিত থাকে, তেমনই প্রাক্তনী বা সেই বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন বহু মানুষই আসেন সেখানে। সে ক্ষেত্রে কাউকে ‘বহিরাগত’ বলা যায় কি? প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন উপাচার্য নিজেই! তাই তাঁর কাছে এই ‘বহিরাগত’ কথাটি সম্পূর্ণ অর্থহীন প্রলাপের মতোই মনে হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের জিজ্ঞাস্য, বহিরাগত কারা? যাদবপুরের খোলামেলা পরিবেশে বহিরাগত তত্ত্বের স্থানই বা কোথায়? এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ত্রিগুণা সেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতেন, তা ছিল উন্মুক্ত ও অবাধ। সকলের প্রবেশাধিকার রয়েছে সেখানে। তাঁর মতে, ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে তাই যাদবপুরে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের জড়ো হওয়াকে বহিরাগতের জমায়েত বলা শুধু অযৌক্তিক নয় অভিসন্ধিমূলকও বটে। খুবই প্রনিধানযোগ্য আনন্দদেব বাবুর এই শেষ কথাটি। 

“সমস্ত সভ্যদেশ আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবারিত আতিথ্য করে থাকে। যার সম্পদে উদ্বৃত্ত আছে সেই ডাকে অতিথিকে। গৃহস্থ আপন অতিথিশালায় বিশ্বকে স্বীকার করে। নালান্দায় ভারত আপন জ্ঞানের অন্নসত্র খুলেছিল স্বদেশ বিদেশের সকল অভ্যাগতের জন্য। ভারত সেদিন অনুভব করেছিল, তার এমন সম্পদ পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে সকল মানুষকে দিতে পারলে তবেই যার চরম সার্থকতা। পাশ্চাত্য মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই বিদ্যার এই অতিথিশালা বর্তমান। সেখানে স্বদেশী-বিদেশীর ভেদ নাই। সেখানে জ্ঞানের বিশ্বক্ষেত্রে সব মানুষই পরস্পর আপন। সমাজের আর-আর প্রায় সকল অংশেই ভেদের প্রাচীর প্রতিদিন দূর্লঙ্ঘ্য হয়ে উঠেছে; কেবল মানুষের আমন্ত্রণ রইল জ্ঞানের এই মহাতীর্থে। কেননা এইখানে দৈন্যস্বীকার, এইখানে কৃপণতা, ভদ্রজাতির পক্ষে সকলের চেয়ে আত্মলাঘব। সৌভাগ্যবান দেশের প্রাঙ্গণ এইখানে বিশ্বের দিকে উন্মুক্ত”। বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে প্রায় বিরাশি বছর পূর্বে, ১৯৩২ এর ডিসেম্বরে। আর সেখানে প্রায় এক শতাব্দী পরে যাদবপুরের স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব প্রচার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে একে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করতে। রবীন্দ্রনাথের এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেসের ডিরেক্টর ও শিক্ষক অভিজিৎ গুপ্তর কথায়। প্রসঙ্গত শ্রী গুপ্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্রও বটে। তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় বা ক্যাম্পাস শুধু ছাত্র, শিক্ষক বা কর্মচারীদের সমষ্টি নয়, তাদের বলয়ের মত আলিঙ্গন করে থাকে বৃহত্তর এক সম্প্রদায় বা কমিউনিটি। এই দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে তিনি আরও বললেন, “শুষ্ক, আত্মকেন্দ্রিক, পুঁথিসর্বস্ব বিদ্যাভ্যাসের কবল থেকে মুক্তির প্রাথমিক শর্ত যে দ্বারোদঘাটন, তার সামনে ভীষন রাক্ষসের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ায় সীমান্ত, কাঁটাতার, পাসপোর্ট পরীক্ষক। এই অমঙ্গল সরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের বিদ্যাভাস আরও দীর্ণ, আরও ক্লিষ্ট, আকার ধারণ করবে”। বিরাশি বছর আগে জ্ঞানের যে মহাতীর্থের প্রাঙ্গণকে বিশ্বের দিকে উন্মুক্ত রাখার উপরেই জোর দিয়েছিলেন বিশ্বকবি দ্যর্থহীন ভাবে।

জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সেই মিলনতীর্থের প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত পরিসরকে প্রশাসনিক কলকব্জা দিয়ে আবদ্ধ করার এই যে অপপ্রয়াস, এর পশ্চাতে আদতেই কোনো দূরভিসন্ধিমূলক গভীর ষড়য়ন্ত্র আছে কিনা সময়ই তা স্পষ্ট করে দেবে হয়ত, কিন্তু আশঙ্কার জায়গাটি হল; ততদিনে এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ত তার এতদিনের স্বাধীন অর্জনের উৎকর্ষতাটুকু হারিয়ে ফেলবে! শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সজীব সংযোগের পরিসর ও তাদের স্বাধীন চিত্তবৃত্তির মৌলিক বিকাশের জন্য আবিশ্ব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এত সুনাম; সেইটি অবরূদ্ধ হলে সেটি শুধু যাদবপুরেরই ক্ষতি নয়, সে ক্ষতি দেশ কাল জাতির গন্ডী ছাড়িয়ে মানুষের সমাজ সংসারেরই ক্ষতি হয়ে দাঁড়াতে পারে একদিন। শুভবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই আজ এইটি আশঙ্কা করে শঙ্কিত! ঠিক যে কারণে এই বহিরাগত তত্ত্বকে অভিসন্ধিমূলক বলতে বাধ্য হয়েছেন আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের মত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদও! কিন্তু কেন এই বহিরাগত তত্ত্ব? কেনই বা যাদবপুরকে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করার এই আশু প্রয়াস!

সেইটি বুঝতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। এরাজ্যে ভুতপূর্ব সরকারের প্রায় সাড়ে তিন দশকের শাসনকালে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিকে সরকারী দলের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেগুলিকে দলীয় কর্মী সমর্থক তৈরীর কর্মশালায় পরিণত করার কাজটি প্রায় শিল্পের পর্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল! ভুতপূর্ব প্রশাসকরা বুঝতে পেরেছিলেন রাজ্যের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীকে নিজেদের পক্ষে স্থায়ী ভাবে ধরে রাখতে গেলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর থেকেই তাদেরকে নিজেদের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। কারণ আমাদের এই রাজ্যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাচর্চার চাবিকাঠিটি ঐ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেই। আর এই সরল সত্যটি তাদের বুঝতে আদৌ দেরী হয়নি। এবং হয়নি বলেই একটানা সাড়ে তিন দশক তারা চুটিয়ে রাজত্ব করে যেতে পেরেছিলেন। রাজ্যে পরিবর্তনের পর বর্তমান শাসকদল একেবারেই মুখস্থবিদ্যার মতো সেই তত্ত্বটিকে অন্ধআনুগত্য অনুসরণ করতে প্রথমাবধি মরিয়া হয়ে ঝাঁপিযেছেন। কিন্তু তারা খেয়াল করেননি ভুতপূর্ব শাসক দলটি কতো অধ্যাবসায় সহকারে কতো সুচিন্তিত সুবিন্যস্ত পরিকল্পনায় কত দিনের নিরলস প্রয়াসে নিপূণ ধৈর্য্যের সাথে এবং দৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায় সেই তত্ত্বকে বাস্তবে সফল করে তুলেছিলেন। খেয়াল করেননি, কারণ তাদের অতশত সময় নেই। বাম আমলের সাড়ে তিন দশকের ননী মাখন তাদের সাড়ে তিন বছরেই হাসিল করতে হবে। সেটাই সার সত্য তাদের কাছে। সময় সাপেক্ষ বিষয়কে অতি দ্রুত বাস্তব করতে গেলে তা যে সাদা চোখে উৎকট লাগতে পারে, খেয়াল করেননি তারা সেটাও। পাখির চোখের মতো তাদের একটাই লক্ষ্য; যেনতেন প্রকারেণ ভুতপূর্ব শাসকদলের অর্জিত সাড়ে তিন দশকের সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আধিপত্য! আর সেই আধিপত্যের স্বপ্নেই হঠাৎ জোর ধাক্কা দিয়ে গেছে গত ২০শে সেপ্টেম্বরের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত সেই বৃষ্টিস্নাত মহামিছিল! 

এরাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিসরে ছাত্র আন্দোলনগুলি সংগঠিত পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে মূলত রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক স্বার্থেই। সেই আন্দোলনের অভিমুখও ঠিক করে দেওয়া হয় রাজনৈতিক দলগুলির কার্যালয় থেকেই। এবং এই রাজনৈতিক দলগুলি আপামর ছাত্রসমাজকে নিজেদের ছত্রছায়ায় ধরে রাখতে নিজেদের মধ্যে দড়ি টানাটানি করতেই অভ্যস্ত। ফলে ছাত্রসমাজও বিভক্ত থাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে। আর ছাত্রসমাজের মধ্যেকার এই বিভাজন নিশ্চিন্তে রাখে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই। এবং সেই প্রক্ষাপটেই যখন যে দল শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকে, তার প্রাথমিক লক্ষ্যই যে হবে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা, সে আর বিচিত্র কি? কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই, বিশেষত প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত কোন দলই ছাত্রসমাজকে এই রাজনৈতিক দলাদলির উর্দ্ধে উঠে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভিন্নতা ভুলে যুথবদ্ধ আন্দোলনে জোট বাঁধতে দেখতে চাইবে না কোন অবস্থাতেই! আর ঠিক এইখানেই ২০শে সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিভেজা ঐতিহাসিক সেই মহামিছিল আদতেই পিলে চমকিয়ে দিয়েছিল প্রশাসনের। সমস্ত রাজনৈতিক ভেদাভেদের উর্দ্ধে উঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের ছাত্রছাত্রীরা সেদিন যে যূথবদ্ধ প্রত্যয়ে যাদবপুরের অপমানিত ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে পা মিলিয়ে প্রতিবাদের মিছিলকে স্বতঃস্ফূর্ত মহামিছিলে পরিণত করে তুলেছিল; তা এই রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক কথায় অভুতপূর্ব! রাজনৈতিক দলগুলির মিছিল গড়ে তোলার মেকানিজম ছাড়াই যে এতবড় মহামিছিল সংগঠিত হতে পারে, সে কথা ধারণার অতীত ছিল সব দলেরই। আর এইখানেই নড়েচড়ে বসতে হয়েছে বর্তমান শাসক দলকে। কেননা বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে কখন কি ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না! সেই ঝুঁকি ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে কোনো দলই নিতে পারে না। এই বিষয়ে সব দলই সমান। কোনো দলই ব্যাতিক্রম নয়।

আর তাই অঙ্কুরেই এই ঝুঁকি বিনষ্ট করতে শাসকদল যে দ্রুত তৎপর হয়ে উঠবেন সেটাও খুবই স্বাভাবিক। ঠিক সেইকারণেই এই ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব! সেইকারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করার অভিসন্ধি, যে অভিসন্ধির ইংগিত করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। ছাত্রসমাজের এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন বিকাশকে কোনো রাজনৈতিক দলই মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে তো নয়ই। ছাত্রসমাজকে যত বেশি বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত ও আবদ্ধ করে রাখা যাবে, ততই তাদেরকে দলতন্ত্রের স্বার্থে ব্যবহার করা সহজ ও নিস্কন্টক হবে। এই বিষয়ে সব দলেরই এক রা। আর সেইখান থেকেই প্রশাসনিক ক্ষমতা বলে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে নিজ শিবিরে নিয়ে আসতে সব শাসকদলই সদা তৎপর। ঠিক এই জায়গাতেই শাসকদলের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে যাদবপুর। এই রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সব ব্যাপারেই নেতৃত্ব স্বরূপ। ফলে আজকে যাদবপুরের এই রাজনৈতিক শিবির নিরপেক্ষ স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন কালকে যদি সারা রাজ্যই একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়ায় তবে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে তা যে ঘোর অশনি সঙ্কেত, সেতো বলাই বাহূল্য! সেই অশনি সঙ্কেতই শাসকদলকে তাদের প্রশাসনিক কলকব্জাগুলিকে সক্রিয় করে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন দমনে তৎপর করে তুলেছে। তারা খুব ভালোভাবেই জানেন যে যাদবপুরকে বৃহত্তর ছাত্রসমাজ থেকে এখনই বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ রাজনীতির পক্ষে সমূহ বিপদ। সেই বিচ্ছিন্ন করারই প্রাথমিক পদক্ষেপ স্বরূপ এই ‘বহিরাগত’ তত্ত্ব, ও বিশ্ববিদ্যালয়কে সংরক্ষিত স্থানে পরিণত করে তাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রয়াস।

এখন দেখার, এই রাজ্যের বৃহত্তর ছাত্রসমাজ ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজ কি ভাবে যাদবপুরের পাশে দাঁড়ায়। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরাই বা কি ভাবে এই সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। এবং সময়ই শেষ কথা বলবে, এরাজ্যের ছাত্র আন্দোলনে যাদবপুর ও ২০শে সেপ্টেম্বরের স্বতঃস্ফূর্ত সেই ঐতিহাসিক মহামিছিল কোনো নতুন ধারার সৃষ্টি করতে পারে কিনা।

বিশেষ প্রবন্ধ: ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



বিশেষ প্রবন্ধ



নজরুল সংগীতের কিংবদন্তী  ‘গানের পাখি’ ফিরোজা বেগম
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



কোন কোন শিল্পী তাঁর নানান সৃষ্টির মধ্যে যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন সেই বিশিষ্টতার মধ্যেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকেন মৃত্যুর পরেও বহুকাল । সদ্যপ্রয়াতা সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম ছিলেন তেমনই এক শিল্পী যাকে শুধু একজন সংগীত শিল্পী বলে চিহ্নিত করলে সবটুকু বলা হয় না । নজরুল-গানের শিল্পী হিসাবে নিজেকে কিংবদন্তীর উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ফিরোজা । সেই কবে, ১৯৪২এ ফিরোজা তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন, বারো বছর বয়সে প্রথম কলকাতায় রেডিওতে গান গাইলেন । ফিরোজার গান গাওয়ার পাঠ শুরু অবশ্য তার আগে থেকেই । ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ফিরোজার, ২৮শে জুলাই ১৯৩০ । এবং কি আশ্চর্য স্বামী কমল দাশগুপ্তর জন্মতারিখটাও ছিল তাঁর জন্মের ১৮বছর আগের এক ২৮শে জুলাই । পিতা মোহম্মদ ইসমাইল ছিলেন নামী আইনজীবি । মাতা বেগম কাওকাবুন্নেশা ছিলেন সংগীতানুরাগী । ছয় বছর বয়স থেকেই ফিরোজার গান গাওয়ার শুরু । কিন্তু তাঁর ‘ফিরোজা বেগম’ হয়ে ওঠা মোটেই কুসুম বিছানো পথ ছিল না ।

নিতান্ত শৈশবে পাঁচ/ছয় বছর বয়সে শোনা গানের কথা আমার কি করে মনে আছে কে জানে ! হয়তো জীবনে সেই প্রথম কলের গান শোনার বিস্ময় আজও স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে । পাড়ায় কোন এক বাড়ি থেকে গ্রামফোন রেকর্ডের একটা গান ভেসে আসছিল । ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । তখন, নিতান্ত শৈশবে কার গান, কে গেয়েছেন – এসব জানার কথা নয় । পরে পরিনত বয়সে জেনেছিলাম গানটা ছিল ‘সাপুড়ে’ ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সংগীত পরিচালনায় কানন দেবী গেয়েছিলেন গানটি । তারপর বছর কুড়ি আগে একদিন ভোরে আমার কানের সঙ্গী এফ এম রেডিওতে শুনলাম সেই গান আবার ফিরোজা বেগমের কন্ঠে – ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ । কন্ঠস্বরের কি অনুপম ঐশ্বর্য ! আগেও তাঁর গান অনেক শুনেছি । কিন্তু সেদিন খুব কম প্রচারিত সেই গানের সুর কেন দীর্ঘদিন পরেও মনে থেকে যায়, তার কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই । অনেকেই নজরুলের প্রচুর গান গেয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । সেইসব শিল্পীর কোন একটি বা দুটি গান গায়নগুনে অন্যতর মর্যাদা পেয়ে যায় । সুপ্রভা সরকার গীত ‘কাবেরী নদীজলে কে গো’, জ্ঞাণেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামীর ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্রর ‘শাওন আসিল ফিরে’ কিংবা শচীনদেব বর্মণ গীত ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ এমনই গান, যেগুলি অন্য অনেক শিল্পী গাইলেও মনে থাকে তাঁদেরই গায়নশৈলী । একই কথা বলতে হবে ফিরোজা বেগমের গান সম্পর্কে । ১৯৬০সালে পূজায়, গ্রামফোন রেকর্ডে গাওয়া দুটি গান ‘দূর দ্বীপ বাসিনী’ এবং ‘মোমের পুতুল মমির দেশে’ ফিরোজাকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে । এই গান অনেকেই হয়তো গেয়েছেন, কিন্তু সংশয় নেই যে গানদুটির জন্য ফিরোজা বেগমের কথাই মনে এসে যায় । তেমনই ‘নূরজাহান’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’, ‘আমি চিরতরে দূরে সরে যাব’, ‘ওরে নীল যমুনার জলচিল’এমনই বরষা ছিল সে দিন’, ‘মুশাফির মোছরে আখী জল’ এমন বহু কালজয়ী নজরুল গানে তাঁর কন্ঠের ইন্দ্রজাল অক্ষয় হয়ে আছে ।

৯ বছর বয়সে ফিরোজা কলকাতায় আসেন । কলকাতায় কোন এক গানের আসরে নজরুল ইসলাম তাঁর গান শুনে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন । নজরুল তখনও সুস্থ ও পূর্ণ দীপ্তিতে এবং গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক । এই সময়েই ফিরোজা গ্রামফোন কোম্পানীতে অডিশন দেন । নজরুল ইসলামের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছিলেন এই সময়ে । তারপর ১২ বছর বয়সে ফিরোজার প্রথম গ্রামফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪২এ চিত্ত রায়ের সুরে । গানটির কথা ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ । ঐ বছরই কমল দাশগুপ্তর তত্বাবধানে দুটি উর্দু গান রেকর্ড করেছিলেন । 

ফিরোজা তাঁর কৈশোরে নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন । কিন্তু বাংলা সংগীত ভুবনে তাঁর সূচনা পর্বের সময় নজরুল নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর প্রধান প্রশিক্ষক তখন নজরুল স্নেহধন্য কমল দাশগুপ্ত । ১৯৪০এর দশক থেকে ষাটের দশকটা ছিল বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ । আধুনিক বাংলা গানের ভুবনে তখন শচীন দেববর্মণ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যুথিকা রায়, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত, সুপ্রভা সরকার, তালাত মাহমুদের মত গায়ক, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষের মত সুরকার – সে এক বিস্ময়কর শিল্পী সমাবেশ । ফিরোজা যুক্ত হলেন এই শিল্পী সমাবেশে । মনে রাখা দরকার যে, তখন সমভ্রান্ত মুসলমান পরিবারে মেয়ের পক্ষে রেকর্ডে গান করা মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না । 

নজরুল ইসলাম নীরব হয়ে গেলেন, কিন্তু বাংলা গানের ভান্ডারে রেখে গিয়েছিলেন কয়েক হাজর গান । ফিরোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি অন্য কোন গান নয়, তিনি শুধু নজরুলের গানই গাইবেন । তাঁর নজরুল গীতির কিংবদন্তী শিল্পী হয়ে ওঠায় শংসয়াতীত অবদান ছিল কমল দাসগুপ্তর । কমল দাশগুপ্ত নিজে নজরুলের বহু গানে সুর দিয়েছিলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর সঙ্গীত প্রশিক্ষক থাকা কালীন তিনি একের পর এক নরুলের গান গাইয়ে ছিলেন ফিরোজাকে দিয়ে । নজরুল-গানের মাধুর্যের প্রতি ফিরোজার যে টান তার নির্মাণ করে দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্তই । পাকা জহুরীর মত তিনি চিনেছিলেন ফিরোজা কে । যে ভাবে কমল দাশগুপ্ত ফিরোজার অগ্রজা-প্রতীম যুথীকা রায়কে মীরার ভজনের অনন্য শিল্পী করে তুলেছিলেন । নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালে। এরপর থেকে আর ফিরোজাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । নজরুল সঙ্গীতের নানা রসধারায় সিক্ত হয়ে ফিরোজা বেগম গেয়েছেন, রেকর্ড করেছেন এবং শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন সুরের ইন্দ্রজালে। ফিরোজার কন্ঠ মাধুর্যে যেন নজরুল জীবন্ত হয়ে উঠতেন তাঁর গানে । ফিরোজা বেগম নজরুলের সব ধরনের গান গেয়েছেন। গজল, কীর্তন, ইসলামী গান, দাদরা-নানা ঢঙের সঙ্গীতরসে সিক্ত সঙ্গীতের মালা গেঁথে গেলেন তিনি সেই কৈশোর থেকে আমৃত্যু ।

ফিরোজা ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ এই ১৩বছর কলকাতায় ছিলেন । এই সময়েই ফিরোজার প্রতিষ্ঠা । এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন “দীর্ঘ সময় চিত্ত রায় ও কমল দাশগুপ্তের কাছে গান শিখেছি। কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকে অনেক ধরনের গান শিখেছি। সেই সময় আমরা সবাই এক পরিবারের মতো ছিলাম। একসঙ্গে গান-বাজনা এবং নিয়মিত গানের চর্চা করতাম। প্রায়ই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যেও গান করেছি। পরিবারের কাছ থেকে গান-বাজনা করার জন্য বেশ উৎসাহ পেতাম। তাই হয়তো গান-বাজনা করতে আমার কোনো বাধা ছিল না” । তাঁর সংগীত প্রশিক্ষক, বয়সে তাঁর চেয় ১৮বছরের বড় কমল দাশগুপ্তর সঙ্গেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন ফিরোজা কলকাতায় ১৯৫৫তে । 

ফিরোজার পরিবার, আত্মীয়-পরিজন ও কাছের মানুষেরা ওদের অসম বিবাহ মেনে নেয় নি । ফলে বিবাহপরবর্তী দাম্পত্যজীবন অনেক দুঃখময় থেকেছে । কলকাতায় কমল দাশগুপ্তর কোন বাড়ী ছিলনা । সেই সময়, নানান বিপর্যয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা মোটেই ছিল না । হাতে তেমন কাজও ছিল না । একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে যায় । তার মধ্যেই ফিরোজা স্বামীর সঙ্গে নজরুলের গান ও স্বরলিপি সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে গেছেন । নির্বাক অসুস্থ নজরুলকে গান শোনাতেন । নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে গিয়েছেন । ফিরোজা-কমল দাশগুপ্তর অসম বিবাহ কলকাতাও খুব আদরের সঙ্গে মেনে নিয়েছিল, এমন নয় । বিস্ময়কর মনে হবে যে, কলকাতায় থাকাকালীন অজস্র নজরুলগীতি রেকর্ডে গেয়েছিলেন ফিরোজা, কিন্তু কলকাতার একটিও গানের জলসায় গান গাইবার জন্য তাঁর উপস্থিতি দেখা যায় নি । অথচ বাংলা গানের সেই স্বর্ণ যুগে কলকাতায় গানের জলসা লেগেই থাকতো । ১৯৭২এর ২৭শে অক্টবর কলকাতার রবীন্দ্র সদনে প্রথম একক সংগীতানুষ্ঠান করেন ফিরোজা । তখন তিনি ঢাকায় চলে গিয়েছেন সপরিবারে ।

১৯৬৭তে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য সপরিবারে ঢাকায় চলে গেলেন ফিরোজা । ওখানে তখন আয়ুব খানের সামরিক শাসন । শোনা যায় ফিরোজাদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা ছাড়ার ফতোয়া জারি হয়েছিল । সেই সময় তাঁর পরিবার ও অনেক মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কোন সমঝোতা করেননি ফিরোজা । তাই সেই আয়ুব খান সরকার যখন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের উদবোধনে প্রথম গানটি গাইবার জন্য ফিরোজা বেগমকে আমন্ত্রণ করেন, ফিরোজা শর্ত দিয়েছিলেন তিনি উর্দু নয় - বাংলা গান গাইতে দিতে হবে । নজরুলের ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি, আমার দেশের মাটি’ গানটি গেয়েই সূচনা করেছিলেন ইসলামাবাদ টেলিভিশন কেন্দ্রের ।' নিজের ঐন্দ্রজালিক কন্ঠ নিয়ে অন্য অনেকের মতই চলচ্চিত্র বা লঘু গান করে পরিবারের আর্থিক সুরাহা করতে পারতেন । নজরুল গানে নিবেদিতা ফিরোজা সে পথে যাননি । স্বামী কমল দাশগুপ্ত পঞ্চাশের দশকে সুরকার হিসাবে যার ভারতজোড়া খ্যাতি, প্রায় আট হাজার গানের সুরকার – তাকে ঢাকায় মুদিখানার দোকান খুলতে হয়েছিল আর্থিক সংস্থানের জন্য । স্বাধীনতার পর, ১৯৭২এ বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সে দেশে নিয়ে আসেন জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে । বাংলা দেশে নজরুল চর্চা গতি লাভ করে । গড়ে ওঠে নজরুল ইনস্টিটিউট – যার ভাবনা ফিরোজা বেগমের । সেখানে ফিরোজা বেগম নজরুল সঙ্গীতের স্বরলিপি প্রত্যয়ন বোর্ডেরও প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৭৪এর ২০শে জুলাই নিতান্ত অনাদরে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় স্বামী কমল দাশগুপ্তর আর গত ৯ই সেপ্টেম্বর চলে গেলেন এক হাজার ছ’শ গান করা এই প্রবাদপ্রতীম সংগীত শিল্পী ৮৪ বছর বয়সে ।

দীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন তেমনভাবে প্রচারের আলোয় না থাকা ফিরোজা । কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই তাঁর শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান বিশ্বের অগণিত বাঙ্গালীর হৃদয়ে নজরুল-গানের কিংবদন্তী, ‘গানের পাখি’ হয়ে তাদের হৃদয়ে বিরাজ করা ।

প্রবন্ধ: অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



প্রবন্ধ



তামাক যুদ্ধ 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 



সিগারেটের প্যাকেটের ওপর জ্বলজ্বল করে একটি সাবধানবাণী – Smoking Kills। সঙ্গে থাকে মানবদেহের অভ্যন্তরের একটি ছবি। ফুসফুসে লাল বৃত্তের মধ্যে লাল তির নির্দেশ করছে ক্যান্সারের আক্রমণ। বলাই বাহুল্য, সিগারেট কোম্পানিগুলি শুভবুদ্ধির দায়ে তাদের মুনাফার ধনটিকে এমন লালিমালিপ্ত করে বাজারে ছাড়ছে না। এটা তাদের বাধ্যতা। এই বাধ্যতা, সঙ্গে আরও অনেক নিয়ন্ত্রণ-বিধি বিনা যুদ্ধে তারা স্বীকার করেনি। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক সেই যুদ্ধের কাহিনিই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বড় লড়াইটি জিতে দেশটি ক্রমশই দৈত্যরূপ ধারণ করতে চলেছে। দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যটি দিনে দিনে পুষ্টতর; অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসা তো আছেই। তার ওপরে তামাকের ব্যবসা ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী। সিগারেট বিক্রি বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে চলেছে। বিজ্ঞাপনে সিগারেট কোম্পানিগুলি শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। তামাক উৎপাদক দক্ষিণী রাজ্যগুলি এবং সিগারেট কোম্পানিগুলি মিলে যে তামাক লবি – সেটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ। মার্কিন কংগ্রেসে তাদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি। আবার, আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর বার্ষিক অধিবেশনে ডাক্তারদের বিনামূল্যে সিগারেট বিতরণ করে তারা। চিকিৎসকেরা তামাক বুথে লাইন দিয়ে সেই সিগারেট সংগ্রহ করেন। মেডিক্যাল জার্নালগুলিতে নিয়মিত সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে। ফিলিপ মরিস মার্লবোরো ব্র্যান্ডের ফিল্টার্ড সিগারেট বাজারে ছাড়লেন ‘অনেস্ট টোব্যাকো’ ছাপ্পা মেরে। ওই ব্র্যান্ডের সিগারেটের বিক্রি শতকরা ৫০০০ ভাগ বেড়ে গেল। 

অন্য দিকে ক্যান্সার রোগটি সারা দেশে ক্রমবর্ধমান। সারা পৃথিবী জুড়ে এই রোগটির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে, যুক্তরাষ্ট্র বহুলাংশে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি – সব ধরনের জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলি ক্যান্সার চিকিৎসার গবেষণায় কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছে। শল্য চিকিৎসা, রেডিয়াম থেরাপি, কেমোথেরাপি নিয়ে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন চিকিৎসাবিদরা এই যুদ্ধে। অধিক কার্যকরী চিকিৎসার জন্যে গবেষণা চলছে বিস্তৃত ক্ষেত্রে। কিন্তু রোগটিকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। রোগটির কারণ খুঁজে বের করতে চিকিৎসাবিদ্যার বিভিন্ন বিভাগ আলাদা আলাদা করে অন্বেষণ করছেন, কিন্তু সদুত্তর মিলছে না কোনমতেই। গত বেশ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসা বিভাগের সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু বিজ্ঞানী ফুসফুসের ক্যান্সারে ধূমপানের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করছিলেন। বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিমত মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হতে দেখে সুসংগঠিত তামাক লবির অনুমান করতে অসুবিধে হয়নি যে তারা অদূর ভবিষ্যতে অঙ্কোলজিস্ট সহ সব ধরনের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলির আক্রমণের লক্ষ্য হতে যাচ্ছে। সিগারেটে ফিল্টার লাগিয়ে সেটিকে নিরাপদ আখ্যা দেওয়া সেই আক্রমণ ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপ। 

তামাক লবির আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না বছরখানেকের মধ্যেই তার আঁচ পাওয়া গেল। ব্রিটেনে গত দু-দশকে ফুসফুসের ক্যান্সার পনের গুণ বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার তার কারণ অনুসন্ধানে বিখ্যাত জৈব পরিসংখ্যানবিদ অস্টিন ব্র্যাডফোর্ড হিল-এর ওপর গবেষণার দায়িত্ব দেন। হিল, রিচার্ড ডল নামে এক প্রতিভাবান চিকিৎসা-গবেষকের সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে আট বছর গবেষণা চালিয়ে তার ফল প্রকাশ করলেন ১৯৫৬ সালে। দেখা গেল, ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা পাঁচ থেকে দশগুণ বেড়ে যায়। কেবল ফুসফুসই নয়, ধূমপানের ফলে ঠোঁট, গলা, জিভ এবং অন্ননালিতেও ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ে। 

এদিকে আমেরিকাতেও আর্নস্ট ওয়াইন্ডার নামে এক তরুণ সার্জনের মনে ফুসফুসের ক্যান্সারে নিকোটিনের ভূমিকা নিয়ে সংশয় জাগে। এই নিয়ে গবেষণার ইচ্ছে নিয়ে তিনি সার্জন জেনারেলের দ্বারস্থ হলেন। সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি যখন হতাশ তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন সেন্ট লুই হাসপাতালের দক্ষ শল্যবিদ ইভার্টস গ্রাহাম যিনি প্রতি সপ্তাহে ডজন ডজন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগির অস্ত্রোপচার করেন এবং যাঁকে কদাচিৎ জ্বলন্ত সিগারেট ছাড়া দেখতে পাওয়া যায়। ওয়াইন্ডারের গবেষণায় তাঁর আগ্রহের কারণ ছিল ক্যান্সারের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্কটি প্রমাণ করা নয়, বরং সেটি অপ্রমাণ করা। কিন্তু অনুসন্ধানের গভীরে ঢুকে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস অন্তর্হিত হল। তিনি ধূমপান ত্যাগ করলেন এবং ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর এক প্রবন্ধের উপসংহারে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ধূমপানের বিরুদ্ধে অন্তত একটি সতর্কবাণী উচ্চারণের আবেদন রাখলেন। এখানেই শেষ হল না ব্যাপারটা। ১৯৫৬ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন গ্রাহাম। আবিষ্কৃত হল ফুসফুসে ক্যান্সার এবং দু-মাসও লাগল না তাঁর জীবনশিখাটুকু নিভে যেতে। মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি তাঁর এক বন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়ে গেলেন, তাঁর পঞ্চাশ বছরের ধূমপান মধ্যরাতের তস্করের মত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রাণ। 

তামাক-ক্যান্সার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই দুই গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হলেও, এমনকি গ্রাহামের সাবধানবাণী ও মৃত্যু সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি জনস্বাস্থ্য দপ্তর, দেখা গেল, অবিচলিত। উল্টো দিকে তামাক লবি এই গবেষণার ফল প্রকাশের দু-বছর আগে থেকেই অতি সক্রিয় হয়ে উঠল। তাদের দায় দুটো; এক, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ‘অপপ্রচার’ নস্যাৎ করে উপভোক্তাদের অভয় দান; দুই, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য তামাক-বিরোধী আইন প্রণয়ন ঠেকানো। ১৯৫৩ সালের ২৮শে ডিসেম্বর নিউইয়র্কের প্লাজা হোটেলে বিভিন্ন কোম্পানির মাথাগুলি এক হয়ে ‘খোলামেলা কথা(Frank Statement)’ শিরোনামের এক বিজ্ঞাপনের খসড়া তৈরি করলেন। ১৯৫৪ সালে সেটি সব ধরনের গণমাধ্যমে ঢাক-ঢোল সহযোগে প্রচারিত হল। প্রকৃত প্রস্তাবে খোলামেলা কথায় তথ্যগুলিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল আর তামাকের ক্যান্সার সংযোগ নিয়ে এক শ্রেণির বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে সংশয় ছিল তার ওপর ইচ্ছেমত রং চড়ানো হল। জনসাধারণের মনে সংশয় সৃষ্টি করার এই কৌশলটি এমন কিছু অভিনব নয়। কিন্তু তাদের শেষ চালটি হল সত্যিই মোক্ষম। তামাক-ক্যান্সার সংযোগ নিয়ে গবেষণাকে উপেক্ষা না করে এ ব্যাপারে তাঁরা আরও বিস্তৃত গবেষণা করার জন্যে বিজ্ঞানীদের সমস্ত রকম সাহায্য ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। অর্থাৎ কিনা, জনস্বার্থে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন আছে, যেহেতু বিষয়টির নির্দিষ্ট কোন ফয়সালা হয়নি; সুতরাং গবেষণা চলতে থাকুক, জনসাধারণের তামাকু-সেবনও অবাধে চলুক। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা টোব্যাকো ইন্সটিটিউট রিসার্চ কমিটি(T I R C) নামে একটি সংস্থাও গঠন করে ফেললেন। বোঝা গেল এই সংস্থার কাজ হবে যুযুধান দুই পক্ষ (চিকিৎসা সংগঠন ও তামাক লবি) এবং বিভ্রান্ত জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন করা। খুঁজে পেতে তাঁরা এই কমিটির পরিচালক পদের জন্যে একজন উপযুক্ত লোকও জোগাড় করে ফেললেন। ইনি হলেন অ্যামেরিকান সোসাইটি ফর দ্য কন্ট্রোল অব ক্যান্সার (A S C C ) এর একদা প্রেসিডেন্ট ক্লারেন্স বুক লিটল, যিনি মনে করতেন ক্যান্সারের জন্যে সিগারেটকে দায়ী করা আর বৃষ্টি পড়ার জন্যে ছাতার ওপর দোষারোপ করা একই জিনিস। 

এইভাবে যুদ্ধের উপক্রমণিকাটি তৈরি হয়ে রইল। আসল যুদ্ধ শুরু হতে কেটে গেল আরও সাতটা বছর। কারণ, প্রথম পক্ষটি (তামাক লবি) সংগঠিত ও শক্তিশালী হলে কি হবে, বিরোধী পক্ষটি বহুধা; এর মধ্যে যেমন আছে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদ অধ্যুষিত সরকারি ও বেসরকারি জনস্বাস্থ্য সংস্থা, তেমনি আছেন এককভাবে বহু আইনবিদ ও সাধারণ নাগরিকও। এদের মিত্রশক্তিতে পরিণত হওয়ার প্রয়াসের কোন সম্ভাবনাও ছিল না। কাজেই শক্তির বিচারে তামাকশিল্প দানব হলে অন্য পক্ষ নেহাতই কয়েকটি ছাগশিশু ও পিপীলিকা। মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দপ্তরগুলি আমাদের দেশের মতো সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা জাহির করতে পারে না। অ্যামেরিকান গণতন্ত্রে কোন নাগরিকের বা কোন সংস্থার অধিকার খর্ব করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় সংস্থার নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা লড়েও দ্বিতীয় পক্ষ লড়াইটা জমিয়ে দিল। 

হিল-ডল রিপোর্ট, গ্রাহামের সাবধানবাণী ও তাঁর মৃত্যু আমেরিকার স্বাস্থ্য-সচেতন জনমানসে বড় আকারে না হলেও ছোট ছোট আলোড়ন তুলেছিল। বিচ্ছিন্ন সেই সব আলোড়নের অভিঘাত পাঁচ বছর ধরে সরকারকে ধাক্কা মারার পর অবশেষে সরকার একটুখানি নড়েচড়ে বসল। ১৮৬১ সালে অ্যামেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি এবং ন্যাশানাল টিউবারকুলোসিস অ্যাসোসিয়েশন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কেনেডির কাছে একটি যৌথ স্মারকলিপি পেশ করল। তাতে ধূমপানের সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করার জন্যে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করার আবেদন জানানো হল। বলা হল, কমিশনের উদ্দেশ্য হবে তামাকশিল্পের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির তামাকুসেবনের সুখ যতটা সম্ভব কম খর্ব করে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করা; অর্থাৎ, এমন একটা কিছু করা যাতে সাপও মরে অথচ লাঠিটিও না ভাঙ্গে। সুতরাং কেনেডিও তড়িঘড়ি করে সেই সোনার পাথরবাটিটি তৈরি করার দায়িত্ব সার্জন জেনারেল লুথার টেরির ওপর চাপিয়ে দিলেন। উপযুক্ত লোক সন্দেহ নেই। আলাবামার বাসিন্দা টেরির ছোটবেলা কেটেছে তামাকখেতে তামাকপাতা তুলতে তুলতে, আবার ডাক্তারি পাশ করার পর কর্মজীবনের বেশিটাই কেটেছে বিখ্যাত সব ক্যান্সার চিকিৎসকের সান্নিধ্যে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেখতে দেখতে। তো, টেরির সামনে ছিল তিনটি বিকল্প। এক, বিষয়টিকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া; সম্ভাব্য ফলঃ দেশের তিনটি প্রধান চিকিৎসা-সংস্থাকে চটিয়ে দেওয়া। দুই, তামাকজাত দ্রব্য স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক – এই ঘোষণা সম্বলিত একটি বিবৃতি একতরফাভাবে তাঁর অফিস থেকে প্রকাশ করা; সম্ভাব্য ফলঃ তামাক লবি-ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তিগুলির একজোট হয়ে সেই বিবৃতিকে নস্যাৎ করা। তিন, ফলের কথা না ভেবে বিজ্ঞানের তুলাদণ্ডে তামাকের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্কটি মেপে জনসাধারণের চোখে তা তুলে ধরা। 

প্রথমটায় দ্বিধাগ্রস্ত হলেও টেরি ক্রমশ দৃঢ় পদক্ষেপে তৃতীয় পথে এগোলেন। তিনি দশ সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করলেন যাঁরা ধূমপানের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারের যোগসূত্রের সাক্ষ্যগুলি পরীক্ষা করবেন। 

তের মাস ধরে নয় দফায় সারা দেশ জুড়ে সমস্ত রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন দশজন বিশেষজ্ঞ সদস্য আলাদা আলাদা করে। এমন বিশদ এবং অভিনব নিরীক্ষা ক্যান্সার epidemiology (রোগবিস্তার সম্পর্কিত বিদ্যা)’র ইতিহাসে বিরলতম। ধূমপানের রিস্ক ফ্যাক্টর নির্ণয় করতে এই পরীক্ষাগুলিতে এক অভিনব গাণিতিক প্রজ্ঞা (insight) প্রযুক্ত হয়েছিল। বিশদ ব্যাখ্যা সহ কমিটির সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত অবশেষে জমা পড়ল সার্জন জেনারেল লুথার টেরির কাছে। তিনি ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতল সকালে সাংবাদিক পরিপূর্ণ স্টেট অডিটোরিয়ামের রুদ্ধদ্বার কক্ষে ৩৮৭ পৃষ্ঠার ‘বম্বশেল’ টি ফাটালেন। শেলটির নির্যাস এই যে ‘কারণ’ শব্দটি যদি সংঘটক ও সংশ্লিষ্ট অসুখের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর সম্পর্ক বোঝায়, তাহলে ধূমপান অবশ্যই ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি বা একটি প্রধান কারণ। এই একটি বাক্যই তিন দশকব্যাপী সন্দেহ ও বিতর্কের অবসান ঘটাল। 

ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো একটি প্রধান ক্যান্সারের প্রধানতম কারণ ধূমপান, যা কিনা সহজেই বন্ধ করা সম্ভব – এমন একটি বৈজ্ঞানিক তথ্য আমেরিকার মতো কর্কটাতঙ্কে ভোগা দেশে যে রকম আলোড়ন তুলবে বলে ভাবা গিয়েছিল সেরকমটা কিন্তু ঘটল না। পরের দিন সমস্ত ধরনের মিডিয়ায় এটি লিড নিউজ হল ঠিকই কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এমন কিছু প্রতিক্রিয়ার প্রাবল্য দেখা গেল না যার ফলে দেশের তামাক বিরোধী শক্তিগুলি তাদের অস্ত্রে শাণ দিয়ে মাঠে নামতে পারে।(এখানে একটি কৌতুককর তথ্য উল্লেখ করার লোভ সামলানো গেল না -- কমিটির দশজন সদস্যের মধ্যে ঠিক অর্ধেক, অর্থাৎ পাঁচজন ছিলেন ধূমপায়ী; এই সিদ্ধান্তে আসার পর তাঁরা ধূমপান ত্যাগ করেছিলেন বলে শোনা যায়নি।) তবে কি, কমিটির এই সিদ্ধান্ত তামাক বিরোধীদের হাতে একটি বড় অস্ত্র ধরিয়ে দিল। কিন্তু তামাকশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে সরকার? ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা আছে বটে কিন্তু সিগারেটকে অল্পের জন্যে ড্রাগের সংজ্ঞায় ফেলা যাচ্ছে না। সুতরাং সিগারেটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পড়ে রইল একটি মাত্র তালপাতার সেপাই – দ্য ফেডারেল ট্রেড কমিশন বা এফ টি সি। 

এই সংস্থাটির জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্যে। বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য বা অবাস্তব দাবি যাতে কোন উৎপাদক সংস্থা না করে সেটা দেখাই ছিল এর কাজ। কিন্তু ক্রমশ গুরুত্ব হারাতে হারাতে সংস্থাটির তখন মুমূর্ষু অবস্থা। কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে, কর্মচারী অপ্রতুল। বিজ্ঞাপনে কোন্‌ শব্দের পরিবর্তে কোন্‌ শব্দটি সুপ্রযুক্ত হবে সেটা স্থির করার মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ। এই অবস্থায় সার্জন জেনারেল টেরির রিপোর্টটি এফ টি সি-র পক্ষে টনিকের কাজ করল। সংস্থাটিতে তাজা রক্তের সঞ্চার করতে শৃঙ্খলাপরায়ণ তরুণ আইনবিদদের নিয়োগ করা হল। তাঁরা তৎক্ষণাৎ তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়লেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষণা করলেন, যেহেতু সার্জন জেনারেলের রিপোর্ট অনুযায়ী ধুমপানে ক্যান্সারের ঝুঁকি আছে, অতএব উৎপাদকদের বিজ্ঞাপনে এই ঝুঁকির কথা স্বীকার করে উপভোক্তাদের সাবধান করতে হবে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটে এই সাবধানবাণীটি ছেপে দেওয়া – সতর্কবার্তাঃ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। এটি ক্যান্সার এবং অন্যান্য অসুখে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। [ Caution: Cigarette Smoking is Dangerous to Health. It may Cause Death from Cancer and Other Diseases.] সিগারেটের প্রতিটি বিজ্ঞাপনের সঙ্গেও এই সতর্কবার্তাটি রাখতে হবে। 

সর্বনাশ! তালপাতার সেপাইটির দাঁতে এত বিষ কে জানত! তামাক লবি নড়েচড়ে বসল। এফ টি সি জগন্নাথের রথের চাকা যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে। প্রেসিডেন্ট জনসনের বন্ধু ও আইনি উপদেষ্টা অ্যাবে ফোর্টাস (অল্পদিন পরেই ইনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হবেন) এবং টি আর সি সি-র ডিরেক্টর ও কেনটাকির প্রাক্তন গভর্নর আর্ল ক্লিমেন্টস-এর শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। এই দুজনের পরামর্শে তামাককর্তারা সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখলেন, এফ টি সি-র বদলে বরং কংগ্রেসই আইন প্রণয়ন করে তামাকশিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করুক। মরতেই যদি হয় রামের হাতেই মরব, রাবণের হাতে কদাচ নয়। 

জুয়ার দান মনে হলেও আসলে খুব হিসেব করেই চালটি দেওয়া হল। প্রথমত, কংগ্রেস চিরকালই তামাক উৎপাদকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। দক্ষিণী রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটিই হল তামাক। তামাক লবি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক নেতাদের উৎকোচ প্রদান এবং তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে অর্থ সাহায্য করে আসছেন। সুতরাং তামাকশিল্পের পক্ষে চরম ক্ষতিকর কোন ব্যবস্থা তাঁরা নেবেন এমন সম্ভাবনা অকল্পনীয়। দ্বিতীয়ত, এফ টি সি-র এই একতরফাভাবে নেওয়া কঠোর সিদ্ধান্ত রাজনীতির কারবারিদের যারপরনাই বিরক্তি উৎপাদন করেছিল। ফলে হিসেব বলছিল এই সুযোগে কংগ্রেস যা করবে তা এফ টি সি-র দাওয়াই-এর থেকে নরম হতে বাধ্য। 

হলও তাই। তামাক শিল্প নিয়ন্ত্রণে কংগ্রেস যে আইনটি প্রসব করল তার নাম হল ফেডারেল সিগারেট লেবেলিং অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং অ্যাক্ট (F C L A A of 1965) । এই আইনে গঠিত কমিটি-সাব কমিটির শুনানির পর এফ টি সি প্রস্তাবিত সতর্কবার্তাটিকে তরলস্য তরলম করে যে রূপটি দেওয়া হল সেটি এই রকমঃ- সতর্কবার্তাঃ ধূমপান আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে (Cigarette smoking may be hazardous to your health)। অর্থাৎ এফ টি সি প্রস্তাবিত সতর্কবার্তা থেকে ভয়াবহ তিনটি শব্দ – ‘ক্যান্সার’, ‘কারণ’, এবং ‘মৃত্যু’ – বাদ দিয়ে দেওয়া হল। অস্যার্থ, রাজনীতিবিদগণ জনস্বাস্থ্যের বৃহৎ স্বার্থ অপেক্ষা তামাক লবির সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষা করতেই অধিকতর আগ্রহী। বোঝা গেল সিগারেট উৎপাদকদের সর্বোত্তম ফিল্টার কংগ্রেস – সিগারেটে অন্য কিছু ফিল্টার লাগানো বাহুল্য মাত্র! এইভাবে এফ টি সি-র সৈনাপত্যে প্রথম যুদ্ধটিতে তামাক-বিরোধী শক্তির মোটামুটি পরাজয়ই হল বলা চলে। ‘মোটামুটি’ বললাম এই কারণে যে এই যুদ্ধের ফলে তামাক শিল্পের পায়ে একটি আইনি নিয়ন্ত্রণের বেড়ি অন্তত পরানো সম্ভব হল। 

এর বছর দুয়েকের মধ্যেই সদ্য আইন পাশ করা এক তরুণ এটর্নি তামাক-বিরোধীদের সেনাপতির ব্যাটনটি নিজের হাতে তুলে নিলেন। হঠাৎ-ই একদিন জন ব্যানজাফের নজর পড়ল প্রায় অপ্রচারিত একটি আইনি ধারার ওপর । ১৯৪৯ সালে প্রণীত ‘বৈষম্যহীনতার নীতি’ (Fairness Doctrine) নামের এই ধারাটির মোদ্দা কথা হল এই যে বায়ুতরঙ্গ যেহেতু জনসাধারণের সম্পত্তি অতএব এর মাধ্যমে কোন বিতর্কমূলক বিষয় সম্প্রচারিত হলে তার বিরুদ্ধ মত সম্প্রচারেও সমপরিমান সময় ওই মাধ্যমকে দিতে হবে। এই ধারাটি পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া আছে ‘ফেডারেল কম্যুনিকেসন কমিশন’ বা এফ সি সি নামক এক সংস্থার ওপর । ১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে ব্যানজাফ এফ সি সি-র কাছে নিউ ইয়র্কের একটি দূরদর্শন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। অভিযোগ এই যে ওই কেন্দ্রটি তামাক বিরোধী কোন বিজ্ঞাপন না দেখিয়ে কেবলই তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচার করে চলেছে। এমন অসাধারণ অভিযোগটিতে যে কাজের কাজ কিছু হবে তা ব্যানজাফ নিজেও ভাবতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কপাল ভালো। কারণ সে সময় এফ সি সি-র কাউন্সেল জেনারেল হেনরি গেলার নিজেও তামাক বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। তিনি অবিলম্বে ব্যানজাফকে লিখিতভাবে জানালেন, ধূমপান অবশ্যই বিতর্কের বিষয়। সুতরাং দূরদর্শন কেন্দ্রটির অবশ্য- পালনীয় কর্তব্য -- ধূমপান যে কতখানি উপভোগ্য সেটা বিজ্ঞাপিত করার পাশাপাশি ধূমপানের ফলে স্বাস্থ্যের কতখানি ক্ষতি হতে পারে সেটাও সম্প্রচার করা। উৎসাহিত ব্যানজাফ গেলারের অনুমতি নিয়ে কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন আদালতে। প্রত্যাশিতভাবেই তামাক কোম্পানিগুলি তারস্বরে প্রতিবাদ জানাল; বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা তো বাক্‌-স্বাধীনতার ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত! সুতরাং তারা এই আইনি লড়াইএর শেষ দেখে ছাড়বে। দীর্ঘায়িত আদালত-যুদ্ধের আশঙ্কায় ব্যানজাফ অ্যামেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, অ্যামেরিকান লাঙ অ্যাসোসিয়েশন ইত্যাদি বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু কেউই সাহায্যের হাত বাড়াল না তাঁর দিকে। মরিয়া ব্যানজাফ একলাই লড়ে গেলেন তামাক লবির তাবড় তাবড় আইন-বিশারদদের বিরুদ্ধে। ১৯৬৮ সালে আদালত যখন মামলার রায় ঘোষণা করল, তামাক কোম্পানিগুলি বিস্ময়াহত! তাদের অত্যুচ্চ পারিশ্রমিকওয়ালা বাঘা বাঘা সব আইনজীবীরা কিনা ওই না-সাবালক উকিলটার কাছে কুপোকাৎ! আদালত রায় দিল, -- তামাক ও তামাকবিরোধী বিজ্ঞাপনের জন্যে ‘সমানুপাতে সম্প্রচার সময়’ দিতে হবে।  

ব্যস্‌, মাঠে নেমে পড়লেন গেলার এবং তাঁর এফ সি সি। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শোনা গেল কমিশনের দৃপ্ত ঘোষণা – এখন থেকে ‘সমানুপাতিক বিজ্ঞাপনের সময়’-এর ওপর তারা নিয়মিত নজরদারি করবে। শুধু তাই নয়, জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে দূরদর্শনে সিগারেটের বিজ্ঞাপন একেবারে বন্ধ করে দেওয়াটাই হবে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। 

তামাক কোম্পানিগুলি আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের পর আপিল করল কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কোন আপিলই গ্রহণ করল না। ফলে বানজাফ-রায়ই চূড়ান্ত হয়ে থাকল। তাই কোম্পানিগুলির বিজ্ঞাপনে এবার নতুন কৌশল লক্ষ্য করা যেতে লাগল; তারা সিগারেটের ক্ষতিকারক প্রভাবটির ওপর ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে বিজ্ঞাপন বানাতে লাগল। পাল্‌টা দাওয়াই বের করতে তামাক-বিরোধীদের সময় লাগল না। তারা একের পর এক বিজ্ঞাপনে তামাক কোম্পানির ‘সংশয়’-কে ‘ভয়’ দিয়ে ঢেকে দিতে শুরু করল। প্রবীণ অভিনেতা উইলিয়াম টলম্যান এমনই এক বিজ্ঞাপনে বললেন, ধূমপানের ফলে তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে মরতে বসেছেন। ধূমপানের এইসব নেতিবাচক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তামাক লবি অবশেষে তাদের সমস্ত বিজ্ঞাপন দূরদর্শন থেকে তুলে নিতে বাধ্য হল। কারণ সহজবোধ্য; সিগারেটের বিজ্ঞাপন না থাকলে ভয়-দেখানো এই সব ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর বিজ্ঞাপনগুলিও আর থাকে না। ১৯৭১ সালের ১লা জানুয়ারি তামাক কোম্পানির শেষ বিজ্ঞাপনটি দূরদর্শনে প্রচারিত হয়েছিল। এভাবেই এক সময়ের অমিততেজা তামাকদানবটিকে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে হল। ফল হল এই যে যুক্তরাষ্ট্রে ছ’টি দশক ধরে ক্রমশ বাড়তে থাকা সিগারেট বিক্রির পরিমাণ সাতের দশকে এসে মাথাপিছু বার্ষিক চার হাজারে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। 

যুদ্ধ কিন্তু শেষ হল না। তামাক লবি রণাঙ্গন ছাড়লে কি হবে, তামাকবিরোধীরা তাদের পিছু ছাড়ল না। এতদিন তারা লড়াই চালাচ্ছিল নিরাবয়ব সব ‘তামাক-বলি’দের হয়ে। বিমূর্ত শিকার এবার মূর্তি ধারণ করে তামাকদানবকে তাড়া করল। বিমূর্ত ভিক্টিমদের প্রথম মূর্ত প্রতিনিধি রোজ সিপোলোন। ১৯৪২ সালে বয়ঃসন্ধির রোজ প্রথম স্বাদ নেয় সিগারেটের । ওই সময়টিকে তামাক শিল্পের ‘মোহিনী’ যুগ বলা যেতে পারে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সালে এসে মহিলা ধূমপায়ীর সংখ্যা এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। পুরো কৃতিত্বটাই ছিল বিজ্ঞাপনের। অ্যামেরিকান সমাজে মেয়েরা তখন চূড়ান্ত চাপের মধ্যে; আত্মপরিচয়, শিশুপালন, গৃহস্থালি ও কর্মক্ষেত্র – এই চার পরস্পর বিরোধী ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। বিজ্ঞাপন বলতে লাগল এই চাপের মুখে স্নায়ু শীতল রাখার চমৎকার দাওয়াই হচ্ছে সিগারেটে টান। আরও বহু মহিলার মতো রোজও তা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিল। আর্থিক মন্দা-র কবলে পড়ে একদিন রোজকে পড়াশুনায় ইতি টেনে কাজে নামতে হল। এক স্কার্ফ ফ্যাক্টরিতে প্রথমে প্যাকার, পরে বিলিং ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতে করতে তার ধূমপানের নেশা বেড়েই চলল। অ্যান্টনি সিপোলোনের সঙ্গে বিয়ের পর রোজের মনে একটা টানাপড়েন শুরু হল। অ্যান্টনি তামাক বিরোধী; সে প্রতিদিন ধূমপানের ক্ষতিকারক দিকগুলি বিভিন্নভাবে রোজের সামনে তুলে ধরতে লাগল। রোজ চেষ্টা শুরু করল অভ্যাসটি ছাড়ার, কিন্তু ছাড়ার কয়েকদিন পরেই আবার ধরে এবং তখন তার ধূমপানের ওপর নির্ভরতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে; বাড়িতে সিগারেট ফুরিয়ে গেলে অ্যাসট্রে ঘেঁটে পোড়া সিগারেটের টুকরো খুঁজতে থাকে। পরের ধাপে সে ধূমপান ছাড়ার ভাবনা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ ফিল্টারের সন্ধানে একের পর এক ব্র্যান্ড পরিবর্তন করতে থাকে। 

১৯৮১ সালের শীতকালে ঠাণ্ডা লাগার চিকিৎসা করতে গিয়ে এক্সরেতে টিউমার ধরা পড়ল রোজের ডান ফুসফুসে। বায়োপ্‌সি রিপোর্ট পজিটিভ। দু-বছরের মধ্যে ক্যান্সার ফুসফুস থেকে লিভার ও হাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে গেল। কেমোথেরাপিতে কোন সাড়া মিলল না। ক্যান্সার- কোষে ছেয়ে গেল মজ্জা, মস্তিষ্ক ও শিরদাঁড়া। মরফিনে আচ্ছন্ন শয্যাশায়ী রোজ সিপোলোন ১৯৮৪ সালের ২১ শে অক্টোবর সকালে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল। 

নিউ জার্সির এক এটর্নি, মার্ক এডেল, রোজের মৃত্যুর এগারো মাস আগে জানতে পারেন তার কর্কটাক্রান্ত হওয়ার কথা। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি এডেলের গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল ক্ষতিপূরণের মামলায়। তামাকের বিরুদ্ধে আইনি আক্রমণ চালানোর জন্যে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি এমনই এক ব্যক্তির খোঁজে ছিলেন যে হতে পারে ধূমপানের বলির মূর্ত প্রতিমা। রোজ সিপোলোন খাপ খেয়ে গেল তাঁর পরিকল্পনায়। সিপোলোনদের রাজি করিয়ে ১৯৮৩ সালে এডেল ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করলেন তিনটি প্রধান তামাক কোম্পানির বিরুদ্ধে, প্রধানত যাদের ব্র্যান্ডের সিগারেটে অভ্যস্ত ছিল রোজ। তার আগে, বিগত তিন দশকে তামাক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা কম হয়নি। সেসব মামলার বিচার ও নিস্পত্তি হয়েছিল একটা বাঁধা গতে। বাদিদের বক্তব্য ছিল, ধুমপানে যে বিপদের ঝুঁকি আছে সেটা তারা ব্যক্তিগতভাবে জানত না; উলটো দিকে কোম্পানির যুক্তি, বাদিরা যদি বধির ও অন্ধ না হয় তাহলে তাদের এই যুক্তি ধোপে টেঁকে না। প্রত্যেকটি মামলার রায়ই যায় কোম্পানিদের পক্ষে। জুরিদের মতে সিগারেটের প্যাকেটের ওপর ছাপা সতর্কবার্তা ধূমপায়ীদের সাবধান করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট; অর্থাৎ, তারা জেনে শুনে বিষ পান করেছে – কাজেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। 

রোজ সিপোলোনের মামলাটিকে কিন্তু সম্পূর্ণ উলটো কক্ষপথে বসিয়ে দিলেন ধুরন্ধর এডেল। তিনি বললেন, তাঁর মক্কেল ধূমপানের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। শুধু তাই নয়, তার স্বামী তাকে বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও সে ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। কিন্তু একমাত্র সেটাই আদালতের বিবেচ্য হবে কেন, ধূমপান জনস্বাস্থ্যের পক্ষে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ – সে ব্যাপারে সিগারেট-উৎপাদক কোম্পানিগুলো কতটা কী জানে সেটাও আদালতের জানা উচিৎ। অর্থাৎ, একজন না হয় জেনেশুনে বিষ পান করেছে; অন্যজন জেনেশুনে বিষ দিয়েছে কিনা সেটাও আদালতের বিবেচ্য হওয়া উচিৎ। এডেলের এই অভিনব যুক্তি আদালতকে বাধ্য করল কোম্পানিগুলির অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও তার ফলাফলের রিপোর্ট-সম্বলিত ফাইলগুলিতে এডেলের প্রবেশাধিকার মঞ্জুর করতে। যেন খুলে দেওয়া হল প্যান্ডোরার বাক্স। এডেল কোম্পানির গর্ত থেকে টেনে বের করতে লাগলেন একের পর এক বিষধর সাপ। দেখা গেল, তামাক থেকে ক্যান্সারের সম্ভাবনা এবং নিকোটিনের নেশাগ্রস্ত করে তোলার ক্ষমতা তাদের গবেষণার ফলাফলে স্পষ্ট তো বটেই, উপরন্তু সেই ফলাফল লুকিয়ে রাখতে কোম্পানির অন্দরমহলে এমনভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় যে কিছু বিবেকবান কর্মচারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। জানা গেল কোম্পানির নীতিহীন ত্রিমুখী বিপণন-নীতি – (১) তামাক যে স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক তা সরাসরি অস্বীকার না করে সে ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করা, (২) ধূমপানের অভ্যাসে উৎসাহ না দিয়েও জনগণের ধূমপান করার অধিকারের স্বপক্ষে প্রচার করা এবং (৩) তামাক স্বাস্থ্যের পক্ষে যথার্থ ক্ষতিকর কিনা তা স্থির করার লক্ষ্যে নৈর্ব্যক্তিক গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া। আরও জানা গেল, মানবশরীরে তামাক-নির্গত নিকোটিনের প্রভাব কতটা শক্তিশালী ও বিচিত্রগামী তা কোম্পানিগুলির থেকে ভালো আর কেউই জানে না। রোজের পক্ষে ধূমপান ত্যাগ করাটা যে কঠিন ছিল তার কারণ এই নয় যে তার ইচ্ছাশক্তি দুর্বল ছিল; আসলে নিকোটিন তার ইচ্ছাটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাইরের লোক না জানলেও কোম্পানিগুলি বুঝে গিয়েছিল নিকোটিনের এই ধর্মই তাদের ব্যবসাটিকে চিরজীবী করবে। 

কোম্পানির এই ভ্রষ্টাচারকে শাণিত বিদ্রূপে কীভাবে আদালতে উন্মুক্ত করেছিলেন এডেল, তার একটুখানি নমুনা তুলে ধরা যাক – 

এডেলঃ আপনাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্যটা ঠিক কী ছিল? কোম্পানি কর্তাঃ ইঁদুরের পিঠের টিউমার কমানোর চেষ্টা... এডেলঃ তাহলে মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক কিনা? কোম্পানি কর্তাঃ তা ঠিক... এডেলঃ তাহলে এটার উদ্দেশ্য ধেড়ে ইঁদুরদের রক্ষা করা। ঠিক? না কি নেংটিদের? আপনারা পাঁচ মিলিয়ন ডলার খরচ করলেন কেবলমাত্র নেংটিদের টিউমারের সমস্যার সমাধান করতে! 

তামাক কর্তাদের ভণ্ডামির গভীরতা যে অতলস্পর্শী - এডেলের দিনের পর দিন জেরায় তা প্রতিপন্ন হতে দেখে কোম্পানি-নিযুক্ত আইনজীবীরাও আতঙ্কে শিউরে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি তামাক কোম্পানির গোপন ফাইলে অন্যের প্রবেশাধিকারের আদেশই এই মামলার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে প্রতিপন্ন হল। কেননা দীর্ঘ চার বছর আইনি যুদ্ধের পরে ১৯৮৭ সালে যখন মামলার রায় বেরোল, তখন ঠিক বোঝা গেল না জয়টা কার হল। সিপোলোন পরিবার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই পেলেন। কিন্তু তার পরিমাণ এই চার বছর মামলা চালানোর ব্যয়ের কাছে নস্যিতুল্য। তাদের রায়ে জুরিরা রোজের ক্যান্সারের জন্যে তাকেই শতকরা আশি ভাগ দায়ী করলেন। বাকি কুড়ি ভাগ দায়ী হল একটিমাত্র কোম্পানি যাদের ব্র্যান্ডের সিগারেট ১৯৬৬ সালের আগে পর্যন্ত রোজ ব্যবহার করত। অর্থাৎ, সিগারেটের প্যাকেটে যেদিন থেকে সাবধানবাণী দাগানো হল সেদিন থেকে কোম্পানির আর কোন দায় নেই। ফলে বাকি দুটি কোম্পানি বেবাক ছাড় পেয়ে গেল। মামলা চলাকালীন কোম্পানিকত্তাদের বেজায় হেনস্থা হচ্ছিল। তাঁরা জিততে পারবেন না বুঝেই গিয়েছিলেন। জিতলেনও না; কিন্তু অপর পক্ষের নাক-কাটা জয়টি দেখে বিলক্ষণ উৎফুল্ল হলেন। তবে শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয়কে তুচ্ছ করে এই লড়াই আলোকিত করল অন্য একটি বিষয়কে। ধূমপান-বিড়ম্বিত, দুর্বলচিত্ত রোজ সিপোলোন তার কবরে শুয়ে থেকেও হয়ে উঠল তামাকের বলি অসংখ্য নেশাগ্রস্ত দুর্বল মানুষের মূর্ত প্রতিমা। 

এরপর ঢেউএর মতো আদালতে আছড়ে পড়তে লাগল একের পর এক ক্ষতিপূরণের মামলা। মিসিসিপি রাজ্য বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে তামাক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল। তার পিছনে পিছনে এল ফ্লোরিডা, টেক্সাস এবং মিনোসাটা। তাদের বক্তব্য – তোমরাই স্বাস্থ্যহানির কারণ; তার মূল্য তোমাদেরই চুকাতে হবে। কোম্পানিগুলি সিগারেট প্যাকেটের সতর্কবার্তাটি পতাকার মতো দোলাতে দোলাতে মামলা লড়তে লাগল ঠিকই, কিন্তু জনমানসে হেয় প্রতিপন্ন হতে হতে হতোদ্যম হয়ে এবং বিরূপ প্রচারের হাত থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিল। এক অভিনব পদক্ষেপে চারটি সর্ববৃহৎ সিগারেট উৎপাদক সংস্থা ‘মাস্টার সেট্‌লমেন্ট এগ্রিমেন্ট’ বা এম এস এ নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সামিল হল। এই চুক্তির দলিলে ধূমপানের বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ উঠেছিল - সবই স্বীকার করে নেওয়া হল। ধূমপান যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এবং তার দায় যে উৎপাদক সংস্থাগুলির ওপর বর্তায় – সেটাও মেনে নেওয়া হল। তামাকের বিজ্ঞাপনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এই চুক্তিতেই বলবৎ করা হল। অভ্যন্তরীণ গবেষণার ফলাফলে সকলের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হল। এখানেই শেষ নয়; চুক্তিতে তামাকের অপকারিতা সম্বন্ধে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় মঞ্চ তৈরি করার প্রস্তাব রাখা হল। ১৯৯৮ সালের এই চুক্তিতে পরবর্তীকালে বিশ্বের আরও সাতচল্লিশটি কোম্পানি সামিল হয়। 

এই ঐতিহাসিক চুক্তিটিতে রোজ সিপোলোনের জয় সম্পূর্ণ হল, নাকি আমেরিকার বাজারে ম্রিয়মাণ হয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিশাল বাজারে দীপ্যমান হয়ে ওঠার সূচনা করল তামাক কোম্পানিগুলি, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমেরিকার মাটিতে তামাক যুদ্ধের সূচনার সময় সে দেশে বছরে সিগারেট বিক্রি হত জনপ্রতি ৪১৪১ টি। যুদ্ধের শেষে তা নেমে দাঁড়ায় ২৫০০ টি-তে। তার বিলম্বিত ফল এই যে রোজ-মামলা শুরুর বছরে আমেরিকায় এক লক্ষ পুরুষে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০২। ২০০২ সালে সেই সংখ্যা হল ৭৭। রোজের প্রজন্মের মহিলারা বোধ হয় এখনও তেমনভাবে ধূমপান পরিত্যাগ করতে পারেননি। কেননা, পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহিলাদের মধ্যে লাংস ক্যান্সারাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। 

তামাক যুদ্ধের কাহিনি এখানেই শেষ। কাহিনিটি ধার করলাম সিদ্ধার্থ মুখার্জির পুলিৎজার পুরষ্কার প্রাপ্ত গ্রন্থ ‘দ্য এম্পারার অব অল ম্যালাডিজ’ নামক ক্যান্সার-মহাভারত থেকে। ধার বললাম এই কারণে যে এটি আক্ষরিক অনুবাদ একেবারেই নয়, ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে; কিছু ক্ষেত্রে তথ্য অবিকৃত রেখেও কিছুটা বেশি স্বাধীনতা আমি নিয়েছি। পরিশেষে সামান্য একটু মৌলিক সংযোজন করি। এই লেখাটি পড়ে একজনও ধূমপায়ী-পাঠক যদি ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করেন, তাহলে অনেকগুলি সিগারেটের ধোঁয়ার বিনিময়ে তৈরি এই লেখাটির প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে। সব কিছু জেনেও যে আমি এই ক্ষতিকারক অভ্যাসটিকে সযতনে পুষে রেখেছি তার কারণ এই যে বিশ্বের তাবৎ ছিট্‌গ্রস্ত মানুষের মতো আমারও এ ব্যাপারে একটি মৌলিক ধারণা আছে। এটা সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষের ক্রোমোজোমের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ক্যান্সারের বীজ(অঙ্কোজিন)। কার ক্ষেত্রে সেটি অঙ্কুরিত হবে আর কার ক্ষেত্রে হবে না সেটি কিন্তু এখনও অজানা। যেটুকু জানা তা হল বিশেষ বিশেষ পদার্থ(কার্সিনোজেন) বিশেষ বিশেষ ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। সেই পদার্থগুলি এমনই এক সংকেতবাহী যে-সংকেতে মুহূর্তেই অঙ্কোজিন সক্রিয় হয়ে উঠে কোষ বিভাজন শুরু করে দেয়। লাংস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে নিকোটিন হল কার্সিনোজেন। তবুও সব ধূমপায়ীর যে ক্যান্সার হয় না তার কারণ তাদের পূর্বপুরুষ আগাম অনুমানে ক্যান্সারসম্ভব জিনটিকে অসংবেদি করে রাখেন। আমার পূর্বপুরুষও তাই করে রেখেছেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এমন বিশ্বাস আরও বহু কল্পবিলাসীর আছে বলেই না তামাক বিক্রেতাদের ব্যবসাটি এখনও রমরম করে চলছে!

প্রবন্ধ: অরুণ চট্টোপাধ্যায়



প্রবন্ধ



দুর্গাপুজোঃ 
ধর্ম, উৎসব, সমাজ-সংস্কৃতি নাকি শুধুই ব্যবসা আর বিনোদন ?
অরুণ চট্টোপাধ্যায়




পিতৃসত্য রক্ষা করতে ১৪ বছরের জন্যে বনবাসে এলেন অযোধ্যার যুবরাজ দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্র। সঙ্গে এলেন সাধ্বী স্ত্রী জানকী সীতা আর ভ্রাতৃভক্ত ভাই লক্ষ্মণ। সীতা যে সঙ্গে আসবেন এমনটা কিছু অন্যায় বা অবাস্তব নয় । কারণ তিনি যে রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গিনী ও ধর্মসঙ্গিনী । আর সে যুগে সাতপাকের বন্ধন যে কত দৃঢ় ছিল তা বিভিন্ন শাস্ত্র বা লোকাচারের গল্প থেকেই আমরা জানতে পারি ।কিন্তু লক্ষ্মণের তুলনাহীন ভ্রাতৃভক্তি তাকে টেনে এনেছিল এই বিপদ-সংকুল জঙ্গলে । এখানে লংকার (বর্তমান শ্রীলংকা) রাজা রাবণ রামপত্নী সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে গেল মায়াবী রাক্ষস মারীচের সহযোগিতায় । প্রাণপ্রীয়া সীতাকে উদ্ধারের ব্রত নিয়ে মা দুর্গার তপস্যা করেন রামচন্দ্র । তখন ছিল শরৎকাল । ভক্তের ভক্তি-বৎসলতার আর পত্নী-প্রেমের পরীক্ষা নিতে চাইলেন দেবী । দুর্গা বললেন ১০৮টা নীলপদ্ম দিলে তবেই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে সীতা-উদ্ধারের পথ বাতলে দেবেন । অতিকষ্টে নানা জায়গা থেকে সেগুলি জোগাড় করলেন রামচন্দ্র । এদিকে দেবীর ইঙ্গিতে দেবরাজ ইন্দ্র ছল করে একটি পদ্ম করলেন চুরি । অবশিষ্ট রইল মাত্র একশ সাতটি পদ্ম যা দিয়ে দেবীর আরাধনা সম্ভব নয় । হতাশ রাম তাঁর নিজের একটি চোখ উপড়ে ফেলার জন্য নিজের হাতের তীর নিজের চোখের দিকেই নিবদ্ধ করলেন । আসলে রামের চোখদুটি ছিল ঠিক নীলপদ্মের মত । রামের ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে রামকে নিবারিত করলেন দেবী । আর কাঙ্ক্ষিত বর দিলেন যাতে সীতা-উদ্ধার সহজতর হয় ।

দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তখন থেকে ঘটা করে দুর্গাপুজো চালু করলেন রামচন্দ্র । সে সময়টা ছিল শরৎকাল । সেই থেকেই ধরতে গেলে দুর্গাপুজার মহিমামন্ডিত প্রচলন । আর তাই দুর্গা পুজোকে বলা হয় শারদীয়া পুজো । আগে দুর্গাপুজো হত চৈত্রমাসে । এখনও সে প্রথা অবশ্য অবলুপ্ত হয় নি । তবে সেটা বাসন্তী পুজোয় হয়েছে নামান্তরিত । 

এর আগে বা পরে আরও অনেক কিছু থাকলেও মূল ভিত্তি-কাহিনী কিন্তু এটাই । সুতরাং দুর্গাপুজোর ধর্মীয় ভিত্তি যে বেশ শক্তপোক্ত তা বোঝাই যাচ্ছে । স্বয়ং রামচন্দ্র যেখানে পুজোর প্রবর্তক সেখানে ধর্মীয় আবেগ যে একটা বিশাল মাত্রায় তা অস্বীকার করার যো নেই । সারা ভারতবর্ষেই বিশেষভাবে উত্তরভারতে, প্রায় বেশ কটি বড় রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় এমনকি দক্ষিণ ও উত্তরপূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যেও রাম এবং হনুমান দেবতা হিসেবে পূজিত হন । আর রামায়ণ যে কি বিশাল মাত্রায় বিশেষভাবে হিন্দুদের মনে প্রাণে গেঁথে আছে তা বলাই বাহুল্য । 

শুধু ধর্মীয় আবেগ নয় সামাজিক আবেগও । রাম আর সীতা আজও হিন্দু তথা বাঙ্গালীর মনে সুস্থ এক সমাজের নায়ক ও নায়িকা । মনে রাখবেন যে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকী রামায়ণ রচনা করেন, আধুনিক এমন কি অত্যাধুনিক লেখকরাও চমৎকৃত হয়ে যান । মহাকাব্যই বলুন বা মহা-উপন্যাস, এই আদিকবির তুলনা স্বয়ং তিনি নিজে । এটি শুধু রামের কাহিনী নয়, তৎকালীন গোটা ভারতবর্ষের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি । শুধু তৎকালীন কেন আজও যা ঘটে চলেছে মনে হয় যেন সেই রামায়নের যুগেও এগুলো ঘটত । আর ভবিষ্যতেও সেগুলো ঘটবে ।

রাম ছিলেন বীর, পণ্ডিত, ধর্মজ্ঞ, বিবেচক । আবার তিনি ছিলেন একজন আদর্শ প্রেমিক ও স্বামী । স্ত্রীকে উদ্ধারের জন্য তাঁর উদ্যোগে ভাঁটা পড়ে নি কখনও । এমন কি তার জন্য অনেক কূট কৌশলও অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন (একটি উদাহরণঃ সুগ্রীবকে দোসর করার জন্য অনৈতিক বালি-বধ) । রাম একজন আদর্শ রাজা ও প্রজাপালক ছিলেন । আবার তিনি একজন উপযুক্ত প্রশাসকও ছিলেন । কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে বহু বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে যুগের পর যুগ ধরে । রামায়ণের প্রকান্ড কান্ড আর তার শাখা-প্রশাখাগুলি  নিয়ে তার গভীর আর চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে । সে সব তো অন্য কথা । আমাদের বিষয় হল দুর্গাপুজো নিয়ে । যা বর্তমানে বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে একটি বিশাল উৎসব ।

যদিও দুর্গাপুজো সারা ভারতবর্ষে এমন কি ভারতের বাইরেও প্রচলিত তবু বলতে হবে এই পুজো আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় জাতীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব । এত বড় আকারে আর এতদিন ব্যাপী আর কোনও উৎসব শুধু ভারতের অন্য কোথাও কেন, সারা পৃথিবীর কোথাও নেই । অন্য কোনও ধর্মে এমন কি হিন্দু ধর্মেও এত দীর্ঘ দিনব্যাপি উৎসব দেখাই যায় না । 

শুধু এই চারদিন তো নয়, পুজোর প্রায় মাসাধিক কাল আগে থেকেই বাঙ্গালীরা যে আশা আর আনন্দ বুকে সঞ্চয় করে রাখেন তা এক কথায় অপূর্ব । এটা যদি শুধুমাত্র একটা ধর্মীয় উৎসব হত তার ব্যাপ্তি আর বিশালতা এমন হত না । খেয়াল করে দেখুন বিশ্বকর্মা পুজো থেকে অন্নপূর্ণা বহু পুজো কিন্তু হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান । সেগুলো সব পুজো কিন্তু কেউ উৎসব নয় । উৎসব বললে আমরা সচরাচর সেই জিনিসটাই বুঝি যেখানে অসংখ্য মানুষ বিনা প্ররোচনায় আনন্দে সামিল হয় । উৎসাহে উন্মাদ হয়। অবশ্য ব্যাতিক্রমী কিছু মানুষ সর্বদাই থাকবেন যারা হয়ত এই আনন্দ-জোয়ারে তেমন করে মন ভাসাবেন না । কিন্তু সে অন্য কথা । নিয়মের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যাতিক্রম থাকবেই । সংখ্যায় এঁরা অপ্রতুল ও প্রায় উপেক্ষণীয় । 


দুর্গাপুজো ও ধর্ম 

পুজো এই শব্দটার সঙ্গে ধর্ম এই শব্দটা যেন শক্ত একটা গিঁট দিয়ে বাঁধা । একটা বললে আর একটা এসে পড়ে আপনিই । পুজো মানে হল আরাধনা অর্থাৎ সিদ্ধিলাভের আশায় কাউকে একমনে ডাকা । এই ডাক নির্দিষ্ট মন্ত্রের উচ্চারণেই হোক বা আপন হৃদয় আর মনের ভাষাতেই হোক সেটা বড় কথা নয় । আসল কথাটা হল ডাকা বা আরাধনা করা । কে আমার সিদ্ধি ঘটাতে পারবে আর তাকে কি ভাবেই বা ডাকা হবে সেটা ঠিক করতে হবে আগে । তাই মানুষ কল্পনা করেছে নানা দেব-দেবীর । এই দেব-দেবীরা হলেন মানুষের আদর্শ । তাঁদের অনুসৃত পথ মানুষ অনুসরণ করলে, তাঁদের উপদেশ পালন করলে ভাল ফল পাবে, এইটাই মানুষ ভেবে এসেছে । শুধু ভারতবর্ষেই নয়, আমরা ইতিহাসে আরও অনেক দেশের কথা পড়েছি যাঁরা দেবতার কল্পনা করে তাঁদের পুজো করেছেন । এ বিষয়ে গ্রীকপুরাণ তো আমাদের অনেকেরই জানা । গ্রীকপুরাণ প্রায় হিন্দুপুরাণের মতই নানা দেবদেবীর সুন্দর সুন্দর উপাখ্যানে পূর্ণ । এইসব কাহিনী আর উপদেশ মানুষকে বিভিন্ন যুগে পথ দেখিয়েছে আর দেখাবে এটা হয়ত বেশ কিছু মানুষের বিশ্বাস । আগেই বলেছি দুর্গাপুজো আগেও হত কিন্তু তা ছিল কেবল পুজোই অর্থাৎ হিন্দুদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান । কিন্তু তা হয়ত উৎসবের মর্যাদা ও গুরুত্ব পায় শ্রীরামচন্দ্রের শারদীয় অকালবোধনের পর । সুতরাং বর্তমান দুর্গাপুজোর ধর্মীয় বাতাবরণ অস্বীকার করা যায় না একেবারেই ।


দুর্গাপুজো ও সামজিক প্রেক্ষাপট 

একটি সমাজ মানে হল বেশ কিছু মানুষের সম্মীলিত এক মঞ্চ । এককালে এক একটি ধর্ম বা বিশ্বাস বা পথ নিয়ে এক একটি সমাজ গঠিত হত । যেমন হিন্দু সমাজ, ক্রিশ্চান সমাজ, মুসলিম সমাজ, বৌদ্ধ সমাজ, পার্শি সমাজ, রবীন্দ্রনাথের যুগে ও তৎপরবর্তী কালে ব্রাহ্ম সমাজ প্রভৃতি । পরবর্তী ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষ কিন্তু বিভিন্ন যুগে এই সামাজিক ধ্যান-ধারণার সংকীর্ণ গণ্ডী অতিক্রম করেছে আর করেই যাচ্ছে । শিক্ষা, প্রয়োজন আর আধুনিকতা মানুষকে আজ বৃহত্তর এক গন্ডীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে । তাই এক একটি ধর্মীয় সমাজের সুখ-দুঃখের ভাগীদার অন্য একটি সমাজ নিচ্ছে না বা মন থেকে নিচ্ছে না - এ কথা কি বুক ঠুকে আজ বলা যায় ? শিক্ষা, প্রয়োজন, ভ্রাতৃত্ববোধ আর মানবিকতা আজ যেন বিভিন্ন সমাজকে এক করে দিতে বদ্ধ পরিকর । তাই আজ ঈদ উৎসবে মুসলিম পড়শিভাইয়ের আনন্দে অরুচি কি কোনও হিন্দু ভাইয়ের হয় ? ২৫ শে ডিসেম্বরের বড়দিনে যারা মাতোয়ারা হন তাঁরা কি শুধুই ক্রিশ্চান ? ঠিক তেমনই হল দুর্গাপুজো । এটি বাঙ্গালীদের এক মহামিলনোৎসব – জাতে বাঙ্গালী, ধর্মে নয় । নানা ধর্ম, নানা বর্ণ আজ মিলেমিশে একাকার এই দুর্গাপুজো উৎসবে । অর্থাৎ এখানে সমাজ কিন্তু একটাই আর তা হল বাঙ্গালী দুর্গাপুজো সমাজ । তবে মনে রাখতে হবে এই পুজো বাঙ্গালী অধ্যুষিত হলেও অন্য ভাষাভাষী মানুষ কিন্তু এখানে ব্রাত্য নয়, বরং অধিকতর আদরণীয় । তাই সমাজ একটাই তা হল শারদীয় মহোৎসব সমাজ । সবাই এখানে আনন্দ করে, নিজের নিজের সাধ্য মত খায় বা পরে বা ঘোরে । 


পুজোর একাল-সেকাল

সেকালে বললে বেশী আগের কথা অর্থাৎ আমার জন্মের আগের কথা হয়ত বলতে পারব না তবে ছেলেবেলার কথা বলতে পারি । তখন পুজোয় একটা অপূর্ব ধর্মীয় গাম্ভীর্য বজায় থাকত । পঞ্চমীর গভীর রাতে লরি করে পাড়ার ঠাকুর আসত আর আমরা ঘুম ভেঙ্গে ঘুমচোখে দেখতাম । বুকের মধ্যে আনন্দের এক ঝড় । বাকি রাত আগামী ষষ্ঠীর সকালের কল্পনায় না ঘুমিয়েই কেটে যেত । পরের দিন মুখ ধোবার আগেই ছুটে যেতাম নিরাড়ম্বর এক প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে । কেমন হয়েছে ঠাকুর, কেমন হয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক আর গণেশ । কেমন হয়েছে অসুর, সিংহ, ময়ূর, প্যাঁচা বা ইঁদুর । এরপর এক অন্তহীন অপেক্ষা যেন ঢাকের সেই মধুর আওয়াজ শোনার । তখন ষষ্ঠীর দিন রাত্রে ঠাকুরের হাতে অস্ত্র আর গয়না পরান হত (এখন এগুলি মহালয়ার আগেই সম্পন্ন হয়ে যায় )। মাইকে কখনও বাজত স্তোত্র বা সুমধুর বাংলা সঙ্গীত । হিন্দীগান যে বাজত না তা নয় । তবে তার ছন্দে হৃদয় নাচত শরীর নয় । ধূপ আর ধুনোর গন্ধে চারিদিক মশগুল । দূরে থাকার সুবাদে যাদের দেখা পাওয়া যেত না তাদের দেখতাম এইদিন । কেমন যেন নতুন নতুন লাগত । কেমন যেন একটা সুন্দর সুন্দর গন্ধ ভাসত বাতাসে । আকাশের কি সুন্দর রং । সব নতুন – সব কিছু। পুজোয় সবাই বেশ সামাজিক ও ধর্মীয় আচার পালন করত । মহাষষ্ঠী, মহাষ্টমীতে নিরামিশ, মহানবমীতে মাংস (বলা বাহুল্য, তখন পাঁঠার মাংসই সুপ্রচলিত ছিল, মুরগী বা চিকেন ছিল প্রায় ব্যাতিক্রমের তালিকায় । বিশেষভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণরা এটি গ্রহণ করতেন না )। এর মধ্যে মহাষ্টমীতে ময়দা অর্থাৎ লুচি, ছোলার ডাল, সুজি বা মোহনভোগ বাধ্যতামূলক ছিল বলতে গেলে । নবমী-নিশীথে বাড়ি ফিরতে দেরি হত আর স্নেহের বকুনিও বরাদ্দ ছিল । দশমী ছিল একদিকে দুঃখের আর একদিকে আনন্দের । পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে এই দুঃখের সঙ্গেই আনন্দের বিষয়টা হল মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারটা । তখন বিজয়ার মিষ্টি বলতে নারকোলের ছাপা, নাড়ু, চন্দ্রপুলী, ময়দার গজা, বোঁদে, মিহিদানা ইত্যাদি । ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এগুলোই ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি । তবে এর মধ্যেই জিভে মিষ্টির একঘেয়েমী স্বাদ বদলের জন্য তৈরি হত নারকোল কুরো দিয়ে ঈষৎ ঝাল ঘুঘনি । আমাদের মধ্যে যারা একটু প্রাপ্তবয়স্ক তারা সিদ্ধির শরবত খেয়ে সামান্য টাল খেত । এই একটি দিন নাকি টাল খাওয়াটাও অনুমোদিত ছিল । আজকাল অবশ্য সিদ্ধি কথাটা একমাত্র দুর্গাপুজোর পুরোহিতের ফর্দেই শুধু স্থান পায় । আর স্কচ-হুইস্কি খাবার জন্যে বিজয়া দশমীর দরকার হয় না। এখানে “আমাদের” শব্দটা একটা সার্বজনীন মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে । লেখক এক্ষেত্রে শুধুই একজন প্রতিবেদক মাত্র (অর্থাৎ তিনি নিজের কথা বলছেন না) । পাড়া এবং বহু দূরের লোক একজন অন্য জনের বাড়িতে যেত । বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা ছিল নীতিগতভাবে প্রায় বাধ্যতামূলক । আর বড়রা মাততো পারস্পরিক কোলাকুলিতে । এই এক উৎসব যার আদি আর অন্ত দুইই এক স্নিগ্ধ মিলনের উন্মাদনায় পরিপূর্ণ।


একালের পুজো

দেখতে দেখতে মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর অনেক উন্নতি হল । সারা দেশের সঙ্গে উন্নতিতে ভাগ পেল পশ্চিমবঙ্গও । মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল তার সার্বজনীন পুজোয় চাঁদা দেবার ক্ষমতাও । বাড়ল মানুষের অনুকরণপ্রিয়তা । দেবীর মূর্তি হতে লাগল নানা আকারের । দেবী চলে এলেন মানুষের সমাজের বহু কাছে । ধর্মের মোড়ক খুলে একটু যেন বিনোদনের প্যাকেটে ভরা হতে লাগল পুজোটাকে । দেবী প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গেই আকারে আর প্রকারে বাড়তে লাগল প্যান্ডেল ও অন্যান্য অনুসঙ্গ । আগে যেমন মানুষ শুধু তার পাড়া আর আশপাশের কিছুটা ঘুরে আসত পুজো দেখার জন্যে । এখন সেই সঙ্গে বাড়তে লাগল তার নিজেকে দেখানোর প্রবণতা আর প্রতিযোগিতাও । প্রতিমা দেখার চৌহদ্দি বেড়ে গেল অনেক । সময় আর সাহস দুটোই । এখন হেঁটে যেমন মানুষ যায় তেমনই অসংখ্য মানুষ যায় গাড়িতে করে – ভাড়া বা নিজের । এরপর এল থিমপুজো । প্যান্ডেলগুলো আর প্যান্ডেল রইল না । কেউ হল গুজরাটের সোমনাথের মন্দির তো কেউ হল রাজস্থানের মাউন্ট আবু । আবার কেউ কেউ দেওয়ালে অজস্র ক্ষতচিহ্ন আর বটগাছের বেষ্টনী নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতাব্দী বা তারও বেশী প্রাচীন জমিদার বাড়ী। মানুষ কে আর শখ করে এসব পুরোন বাড়ী দেখতে যায় ? তাই থিমের মধ্যেই এসব দেখে সে ভারি মুগ্ধ । একই অঙ্গে এত রূপ – দেখিনি তো আগে ? তাই আজ পুজোশুরুর অনেক আগে থেকেই সন্ধ্যা আর রাত্রে রাস্তায় পা ফেলাই দূরুহ। সারা রাস্তা আলোকিত । একটা প্যান্ডেলের আলো শেষ হলেই শুরু হচ্ছে আর একটার আলো। ফুচকা, ভেলপুরি, মোগলাই, এগরোল, ফিসফ্রাই, চিকেন রোল আর রেজালা আর কোল্ড ড্রিংসের সুসজ্জিত সমাহার রাস্তার দুধারে । গয়না আর পোশাক নিয়ে প্রতিযোগিতা । - ঠাকুর কতটা দেখব বা দেখতে পাব জানি না (অনেক প্যান্ডেলে আবার তিরুপতি মন্দিরের মত দু ঘন্টা লাইন দিয়ে দু মিনিট ঠাকুর দেখার ব্যবস্থা) তবে, আমি দেখছি তোমাদের, আমাকেও দেখ তোমরা !!


কালের প্রভাব

নামে শারদীয় পুজো । কারণ শরৎকালে হয় বলে । বর্ষার অন্ত । শীতের একটু দেরি আছে । গাঢ় নীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘ ভাসছে । আহা যেন সদ্য ছানা কাটানো হয়েছে । গাঢ় নীল ছানার জলে সাদা সাদা ছানার টুকরোগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে । মাঠে ভরা সাদা কাশফুল। শিউলির গন্ধে চারিদিক আমোদিত । নাতি-বর্ষা-গ্রীষ্ম-শীত এ কাল বড় সুখের । বড় আমোদের । এমন সময় যে কোনও উৎসব তো প্রাণের উৎসব, মনের উৎসব । তাছাড়া আকাশভরা ঐ যে সোনা গলা মিষ্টি রোদ্দুর । ভোরে ঘাসের ডগায় স্বল্প শিশিরের আভাস । নানা জলাশয়ে শালুক আর পদ্মের সুমধুর উদ্ভাস । কল্পনা করুন তো এ সময় যদি কানে আসে ঢাকের মিঠে আওয়াজ, নাকে ঢোকে ধূপ আর ধূনোর গন্ধ ? আপনি পাগল হয়ে যাবেন। উৎসব আপনাকে পাগল করে দেবেই । বিশেষভাবে চারদিন ব্যাপী যে উৎসব । যার একটা দিনের শেষ কিন্তু উৎসবের শেষ নয়, আর একটা দিনের আগাম আভাস মাত্র । 


উৎসব ও পর্যটন

বাঙ্গালী জাতি হিসেবে ভ্রমণপ্রিয় হবার সুখে বড় সুখী । তার এই ভ্রমণপ্রিয়তা আজ ভিন্ন প্রাদেশিক জাতির প্রায় মুখে মুখে উচ্চারিত । ইংরেজ, আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইটালিয়ান, চিনা, জাপানী সব জাতির সঙ্গে এক সারিতে ভ্রমণপ্রিয়তায় যে জাতির নাম তা হল বাঙ্গালী । তারা খেতে আর খাওয়াতে যেমন ভালবাসে তেমনই ভালবাসে যেতে আর নিয়ে যেতে । পুজোর এই শরৎকাল কিন্তু তার ভ্রমণপ্রিয়তায় বেশ কিছুটা আনুকূল্য ঢেলে দিয়েছে । না গরম, না শীত, না বর্ষা এই কালটা বেড়ানোর পক্ষে সত্যি বড় প্রকৃষ্ট । আর চারদিনের একটানা ছুটির সুবর্ণ সুযোগ কে আর হাতছাড়া করে বলুন ? আবার স্কুল, কলেজ, কোর্টকাছারি এমন বহু প্রতিষ্ঠানে ছুটির ভাঁড়ার বেশ একটু স্ফীত । অনেকে এ সময় কেউ পুজো-বোনাস পায় বা কেউ পুজো- এডভান্স বা এক্সগ্রাসিয়া বা অন্য কিছু । কেউ কেউ আবার প্ল্যান করে ব্যাংক বা অন্য আর্থিক সংস্থায় রেকারিং জমা করে থাকেন এই সময়ে ম্যাচিওর করার জন্য । এ সময় প্রচুর ট্রেন বাড়তি দেওয়া হয় সেটা অবশ্যই একটা সুযোগ যা বছরের অন্য সময়ে পাওয়া যায় না । তাই শুধু ভ্রমণপ্রিয় বাঙ্গালীরাই নয় ভ্রমণ সংস্থাগুলোও এ সময় বেশ একটু লাভের মুখ দেখে তা বলাই বাহুল্য । 


দুর্গাপুজো ও ব্যাবসা

দুর্গাপুজোয় নানা খাতে মানুষ প্রচুর খরচ করে থাকে । এর মধ্যে প্রয়োজনের থেকেও প্রাধান্য পায় বিনোদন । ভোগ করব বললেই কিন্তু ভোগ করা যায় না । ভোগের একটা উপযুক্ত সময় আর মাধ্যম চাই । দুর্গাপুজো মানুষের কাছে সেই “সময় আর সুযোগ” এনে দেয় । তাই এ সময় সে কোনও কিছুতেই হিসেবের বাইরেও খরচ করতে কার্পণ্য করে না । এই সুযোগ নেয় অবশ্যই ব্যবসায়ীরাও । বহু জিনিসের দাম এ সময় অনেক অনেক গুণ বেড়ে যায় । অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের ভাষায় যাকে “দাঁও মারা” বলে আর কি । সারা বছর যে পোশাক ঝুলে থাকে দোকানের হ্যাঙ্গারে তাই হয়ত এ সময় শোভা পায় কোনও পোশাকবিলাসীর গায়ে । তাছাড়া “থিমের” দৌলতে এমন বহু জিনিস হয়ত আলেকালে প্রয়োজন হত সেগুলি এখন দুস্প্রাপ্য হয়ে ওঠে । যেমন ধরুন নারকোল ছোবড়া দিয়ে প্যান্ডেল হবে । আগে যদি নারকোল ছোবড়া গদি তৈরির দোকানে ছাতা পড়ত এখন তা লরি লরি আনতে হচ্ছে প্যান্ডেলে ফলে এই “পড়ে থাকা চোদ্দ আনা” পুরো ষোল কেন বত্রিশ এমন কি পুরো পঞ্চাশ আনায় উশুল হয়ে যাচ্ছে । আনাজপাতি, ফলমূল, নানা খাদ্যদ্রব্য, অন্যান্য দরকারি- অদরকারি বহু জিনিস, ফুল (বিশেষভাবে পদ্মফুল), শোলা ও আরও অসংখ্য জিনিস পাওয়া আর দেওয়া নিয়ে প্রায় মারমার কাটকাট অবস্থা । ভ্রমণ সংস্থা, হোটেল ও হলিডে হোম ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীর পক্ষে এই উৎসব হল বড় সুখের সময় ।


অনাকাঙ্ক্ষিত উপসংহার

বছরের পর বছর আমাদের এই মহা-উৎসব দুর্গাপুজো ক্রমেই বিশাল আকার ধারণ করছে । পুজোর সময় তো বটেই পুজোর অনেক আগে থাকতেই কেনা কাটার জন্য শহর বিশেষভাবে কোলকাতার রাস্তাঘাট জনাকীর্ণ হয়ে উঠছে । রাস্তায় যানজট, কোথাও পা ফেলার একটু জায়গা নেই । দোকানে দোকানে মিষ্টিকে ঘেরা পিঁপড়ের স্তুপের মত মানুষের ভীড় । আর পুজোর দিনগুলির কথা তো বলার নয় । শহর কোলকাতা দূরে থাক ছোট ছোট শহরগুলি ও শহরতলি আক্ষরিক অর্থেই যেন জন-সমুদ্রে পরিণত হয় । যে সমস্ত মানুষ হেঁটে ঠাকুর দেখতে পারেন না তাঁদের পক্ষে গাড়ী ভাড়া করেও বেশী দূর যাওয়া সম্ভব হয় না কারণ গাড়ী চলার মত রাস্তাই থাকে না । প্যান্ডেলে প্যন্ডেলে 
উচ্চতা, জমক- প্রদর্শন আর পুরস্কার পাওয়ার প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে । জিনিসের দাম ক্রমশঃ ঊর্ধমুখী এমন কি সাময়িক দুস্প্রাপ্যতাও গ্রাস করে । দর্শনীয় স্থানগুলিতে স্থানাভাব এ তো লেগেই আছে । মনে হচ্ছে যেন উপলক্ষ লক্ষকেও ছাড়াবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে । হয়ত সময়ই বলবে মিলনের উৎসব কোন দিকে যাচ্ছে – ব্যর্থতা কিংবা সাফল্য ।

প্রবন্ধ: স্বপন দেব





প্রবন্ধ




ক্রমবিকাশের ধারায় বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা 
স্বপন দেব



বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার বিস্তৃতি বা ব্যাপ্তি বলতে আমি মোটামুটি কল্লোল-উত্তর যুগের কিছু প্রাচীন কবি-লেখক মণ্ডলী থেকে এ যুগের নবীন এবং সতেজ কবিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। কল্লোল উত্তর যুগের প্রাচীন প্রজন্মের যে কবির কথা প্রথমেই মনে আসে, তিনি হলেন সাম্যবাদী ঘরানার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯)। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থের অবশ্য সংগ্রহের তালিকায় থাকবে, পদাতিক (১৯৪০), যত দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬) এবং, এই ভাই (১৯৭০)। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর থেকেও প্রবীণ কবি ছিলেন অরুণ মিত্র (১৯০৯)। তাঁর মুখ্য রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, প্রান্তরেখা (১৯৪৩), মঞ্চের বাইরে (১৯৭০), আর, শুধু রাতের শব্দ নয় (১৯৭৮)। ঐ একই প্রজন্মের অন্য কবিদের মধ্যে আছেন মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯২০), বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯১৯-৮৭), নরেশ গুহ( ১৯২১), জগন্নাথ চক্রবর্তী( ১৯২৪-৮৯), রাম বসু (১৯২৫)। এঁরা ছাড়াও সেই যুগের আরো দুই প্রতিভাবান কবি হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭), যিনি মাত্র ২০/২১ বছর বয়সে মারা যান এবং কবি বিনয় মজুমদার- ফিরে এসো চাকা (১৯৬২)। কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষ খ্যাতি লাভ করেন ৬০ এর দশকের শেষ দিকে, যদিও তাঁর লেখা শুরু হয় ৫০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে। বর্তমানে, বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ বিখ্যাত কবিদের অন্যতম এবং নবীন প্রজন্মের কবিদের মধ্যে তাঁর চিরন্তন প্রভাব লক্ষণীয়। ব্যাক্তি-স্বাধীনতার সপক্ষে তার খোলাখুলি বাচনভঙ্গী, তাঁর কবিতার সংক্ষিপ্ত নির্মল বৈশিষ্ট এবং তাঁর কবিতায় মিতব্যয়ী অর্থবহ শব্দসমষ্টির প্রয়োগ সমকালীন বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অন্যতম শ্রদ্ধেয় কবি হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।শঙ্খ ঘোষ এর অবশ্য-সংগ্রহের তালিকায় থাকবে, দিনগুলি রাতগুলি (১৯৫৬), মূর্খ বড়, সামাজিক নয় (১৯৭৪), তুমি তো তেমন গৌরী নও (১৯৭৮), পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ (১৯৮০) আর, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (১৯৮৪)। এছাড়াও, শঙ্খ ঘোষ এর নান্দনিক গুণসমৃদ্ধ কিছু রচনা এবং গদ্যের বইও আছে।এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক এক পূজ্য পণ্ডিত ব্যক্তি এবং অসংখ্য বিদেশী কবিতা এবং নাটকের অনুবাদক।

জীবনান্দ-উত্তর যুগে আর এক শীর্ষস্থানীয় লেখকের উত্থান ঘটে। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অসামান্য লেখন পদ্ধতি, ভাষা নিয়ে দুঃসাহসিক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং মানসিক জটিলতা তাঁর কবিতা সমূহ কে বাংলা কাব্য সাহিত্যে এক আলাদা আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর অসামান্য কাব্য গ্রন্থ গুলির মধ্যে ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো (১৯৭২), হেমন্তের অরণ্যে আমি পোষ্টম্যান (১৯৭৭), মানুষ দারুণ কাঁদছে ( ১৯৭৮), এবং, যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো? ( ১৯৮২) বাংলা সাহিত্যের এক চিরন্তন সম্পদ হয়ে থাকবে। 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের থেকেও বয়োজ্যেষ্ঠ আর এক বিখ্যাত কবি নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী(১৯২৪)। তাঁর বিখ্যাত এবং মুখ্য কবিতাগুলি সংগৃহীত হয়েছে, অন্ধকার বারান্দা (১৯৫৪), কোলকাতার যীশু ( ১৯৭০) এবং উলঙ্গ রাজা (১৯৭১) কাব্যগ্রন্থে। নীরেন্দ্রনাথ, আনন্দমেলা নামক কিশোর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বহুদিন। 

বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবেশ একজন গদ্য লেখক হিসেবে হলেও পরবর্ত্তী কালে সুনীল বাংলা কবিতা কেও সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর অসামান্য লেখনীতে। তাঁর অবশ্য-পাঠ্য রচনাবলীর মধ্যে বন্দী জেগে আছো? (১৯৬৯), হঠাৎ নীরার জন্যে ( ১৯৭৮) এবং সোনার মুকুট থেকে (১৯৮২) এক অসামান্য কবি কীর্ত্তির প্রকাশ। 

একটা কথা এখানে উল্লেখ করা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবেনা যে, আনন্দবাজার গ্রুপ পরিচালিত দ্বি-পাক্ষিক সাংস্কৃতিক ম্যাগাজিন দেশ পত্রিকা বহু কবি এবং গদ্য লেখক কে তাদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন এটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। ষাটের দশকের শেষ দিকে বা ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিক তাঁদের জীবনের সাহিত্য পরিক্রমা শুরু করেন এই দেশ পত্রিকার সৌজন্যে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অলক রঞ্জন দাসগুপ্ত(১৯৩৩), তারাপদ রায় (১৯৩৬), অমিতাভ দাশগুপ্ত(১৯৩৫), প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত (১৯৩৭), সামসুল হক, কবিরুল ইসলাম, পূর্ণেন্দু পত্রী, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, সুনীল বসু, শরত কুমার মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত, আশীষ সান্যাল, সিদ্ধেশ্বর সেন (১৯২৬), রত্নেশ্বর হাজরা, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল এবং ভাষ্কর চক্রবর্তী। সমকালীন প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত মহিলা কবিদের মধ্যে আছেন কবিতা সিংহ (১৯৩১), সাধনা মুখোপাধ্যায়, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, কেতকী কুশারী ডাইসন ( ১৯৪০) এবং নবনীতা দেবসেন ( ১৯৩৮)। কেতকী কুশারী এবং নবনীতা দেব সেন এর প্রচুর গদ্য রচনাও বাংলা সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করেছে। 

বাংলা সাহিত্যে নবীনতর কবিদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য কবি জয় গোস্বামী। তাঁর অসামান্য লেখন ভঙ্গিমার সুবাদে বাংলা কবিতার জগতে তিনি বিশেষ সন্মান আদায় করে নিয়েছেন তার পাঠকদের কাছ থেকে। বাংলা শব্দের দুঃসাহসিক প্রয়োগে তার আধিপত্য এবং কোলকাতার রোয়াকের ভাষা কে কবিতায় অনুপ্রবিষ্ট করার তাঁর সাহসী পদক্ষেপ তাঁর কবিতা গুলিকে যেমন একদিকে করেছে প্রাণবন্ত ও সতেজ অন্য দিকে তাঁর রচনায় ও বাক্যে অসাধারণ দার্শনিক উপমার প্রয়োগ ও ব্যবহার কবিতা গুলিকে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল খ্রীষ্টমাস ও শীতের সনেট গুচ্ছ (১৯৭৬), প্রত্নজীব(১৯৭৮), আলেয়াহ্রদ(১৯৮১), উন্মাদের পাঠক্রম (১৯৮৬), ভুতুম ভগবান ( ১৯৮৮), ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা? (১৯৮৯), ফুল গাছে কি ধুলো (২০১১), আত্মীয়-স্বজন (২০১১)। তাঁর এযাবৎ পাওয়া পুরষ্কারগুলির মধ্যে আছে, ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা একাডেমী পুরষ্কার। ১৯৮৯ সালে, ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা ? এর জন্যে আনন্দ-পুরষ্কার।২০০০ সালে পাগলি তোমার সঙ্গে-র জন্যে সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার।

জয় গোস্বামী ছাড়াও নবীনতর প্রজন্মের আরও দুজন উল্লেখযোগ্য কবি হলেন, আর্য সেন এবং অমিতাভ গুপ্ত। এঁরা ছাড়াও, জয়দেব বসু, মৃদুল দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতীম কাঞ্জিলাল, মহুয়া চৌধুরী, ভাষ্কর চক্রবর্তী, সৌম্য দাসগুপ্ত এবং অবশ্যই ঈশানী রায়চৌধুরীর নির্জন অভিমান (২০১২, দে’জ পাবলিশিং) এবং আজকে রাতে লিখতে পারি (২০১৪)।

এইখানে একটা কথা বলার আছে। আমি এর আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, এক সময়ে আনন্দবাজার গ্রুপ পরিচালিত দেশ পত্রিকা অনেক নবীন লেখকের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে অযোধ্যাও আর নেই, সেই রাম ও আর নেই !! নবীনতম প্রজন্মের অনেক কবি সাহিত্যিক ই এখন সচেতন ভাবে তাঁদের কোন লেখাই আনন্দবাজার গ্রুপ এর কোন প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করতে চান না। কারণ তারা মনে করেন, যে আনন্দবাজার গ্রুপ বাংলা সাহিত্য জগতে একচেটিয়া একাধিপত্য কায়েম করে বাংলা সাহিত্যের দিশা কে তাদের কায়েমী রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই নবীনতম প্রজন্মের এই সব কবিরা দেশ পত্রিকা এবং আননদবাজার গ্রুপের অন্য পত্রিকা গুলিকে কে পরিত্যাগ করে বরং কোলকাতা এবং তার কাছাকাছি অসংখ্য ছোট বড়ো লিটিল ম্যাগাজিনে তাদের লেখা প্রকাশ করতে আগ্রহী। অনুষ্টুপ, প্রমা, জিজ্ঞাসা, কৌরব, কবিতীর্থ, মেঘজন্ম, অরণি, সাঁঝবাতি, সময়ের শব্দ এগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। তাই, বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার ক্রমবিকাশের ধারায় এই নবীনতম কবি প্রজন্ম কে বাদ দিলে লেখাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর সেই কারণেই, আমি উপরোক্ত এবং এগুলি ছাড়াও বেশ কিছু লিটিল ম্যাগাজিন ঘেঁটেছি এবং সেখানে অনেক প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কবি বন্ধুর লেখা পড়ে বিমোহিত হয়ে গেছি। পশ্চিমবঙ্গে এই শতকের গোড়ার দিক থেকে এখনো অবধি মানে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সময়টাকে বলা যেতে পারে লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলনের নব-জন্ম।এই সব লিটিল ম্যাগাজিনে যাঁরা নিয়মিত লেখেন এবং যাঁদের লেখা যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন বলে মনে হয়েছে, তাঁদের একটি তালিকা এখানে দিলাম।

সোমব্রত সরকার, সেলিম মালিক, সব্যসাচী মজুমদার, রাজদীপ রায়, রঙ্গীত মিত্র, অতনু সিংহ, কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি, অরূপ ঘোষ, সায়ন সরকার, আত্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণাভ চ্যাটার্জি, তোর্ষা বন্দোপাধ্যায়, রোহন কুদ্দুস, জয়দীপদাম, শুভআঢ্য, মুজিবরআনসারি, শ্রেয়সীচৌধুরী, সুজিতপাত্র, কিশলয় ঠাকুর, শ্রীময়ী ভট্টাচার্য, জয়শীলা গুহ বাগচি এবং আরো অসংখ্য কবিবৃন্দ।এরাই বাংলা কবিতার নতুন ফসল এবং এঁদের কবিতা গুলিও সতেজ সবজির মত স্বাদু।বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার ক্রমবিকাশ একবিংশ শতাব্দীতেও ছড়িয়ে পড়ুক, এই কামনা করে লেখাটি শেষ করলাম।